এখানে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সিলেবাস অনুযায়ী সাজানো আছে
University of Kalyani Suggestion
History Minor Long Question Answer 2024-2025
Course Code: HIST-MI-T-322222
History of Medieval India (মধ্যযুগের ইতিহাস)
UNIT-1
****1) প্রশ্ন. বাজারদর নিয়ন্ত্রণে আলাউদ্দিন খলজি কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন? ৫
Kalyani University BA 3rd Semester History Minor Long Question Answer SAQ Suggestion PDF টি পেতে.. আপনি ১১ টাকা পেমেন্ট করুন। পেমেন্টের পর এক সেকেন্ডের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সাজেশনটি পাবেন। টাকা টি পেমেন্ট করার জন্য নিচে PAY বাটনে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।
আলাউদ্দিন খলজি ছিলেন দিল্লি সালতানাতের একজন ক্ষমতাধর সুলতান, যিনি ১২৯৬ থেকে ১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেছিলেন। তার শাসনামলে বিভিন্ন ধরনের সংস্কারমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বাজারদর নিয়ন্ত্রণ। আলাউদ্দিন খলজির বাজারদর নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগগুলি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় অনেক পরিবর্তন এসেছিল। নিচে আলাউদ্দিন খলজির গৃহীত কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হলো:
১. মূল্যনির্ধারণ:
আলাউদ্দিন খলজি বাজারদরের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রথমত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করেন। তিনি চাল, গম, ডাল, চিনি, ঘি, মাংস, কাপড়, এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের নির্ধারিত দাম বেঁধে দেন। এই মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে তিনি ব্যবসায়ীদের অনৈতিক মুনাফা অর্জনের সুযোগ কমিয়ে আনতে সক্ষম হন। সুলতান নিজে এই মূল্যের উপর কড়া নজরদারি করতেন যাতে কোনো ব্যবসায়ী নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে না পারে।
২. গুদাম এবং বিতরণ ব্যবস্থা:
আলাউদ্দিন খলজি বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য গুদাম এবং বিতরণ ব্যবস্থা স্থাপন করেন। দিল্লিতে তিনি একটি কেন্দ্রিয় গুদাম স্থাপন করেন যেখানে সমস্ত পণ্য মজুদ করা হতো এবং সেখান থেকে তা বিতরণ করা হতো। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি পণ্যের অভাব এবং মূল্য বৃদ্ধির সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হন।
৩. নজরদারি এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা:
বাজারদর নিয়ন্ত্রণে আলাউদ্দিন খলজি কঠোর নজরদারি এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি বাজারে নিয়মিত গোয়েন্দা পাঠাতেন যারা বাজারের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন এবং কোনো ব্যবসায়ী নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করলে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো। এই শাস্তির মধ্যে জরিমানা, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা এবং প্রয়োজনে কারাদণ্ডের ব্যবস্থা ছিল।
৪. মজুতদারি নিষিদ্ধ:
আলাউদ্দিন খলজি মজুতদারির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ব্যবসায়ীরা যাতে পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে, সে জন্য সুলতান মজুতদারি নিষিদ্ধ করেন। যদি কোনো ব্যবসায়ী মজুতদারির সাথে জড়িত থাকত, তবে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো।
৫. পরিবহন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন:
আলাউদ্দিন খলজি পণ্য পরিবহন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নেও মনোনিবেশ করেন। তিনি সড়ক এবং পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়ন করেন যাতে পণ্য দ্রুত এবং নিরাপদে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছাতে পারে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করেন এবং বাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখেন।
৬. রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার:
বাজারদর নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আলাউদ্দিন খলজি রাজস্ব ব্যবস্থারও সংস্কার করেন। তিনি কর আদায়ের পদ্ধতি সহজ এবং কার্যকর করেন যাতে কৃষক এবং সাধারণ জনগণের উপর করের বোঝা কমে। রাজস্ব ব্যবস্থার এই সংস্কারের ফলে কৃষকরা সুষ্ঠু পরিবেশে উৎপাদন কার্য চালাতে পেরেছেন এবং পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে।
উপসংহার:
আলাউদ্দিন খলজির বাজারদর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাগুলি তার শাসনামলে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল। তার এই ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তার শাসনামলে বাজারদর নিয়ন্ত্রণের এই উদ্যোগগুলি ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হয়ে আছে।
***2) প্রশ্ন. আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কারগুলি পর্যালোচনা কর।১০
মধ্যযুগীয় ভারতের অন্যতম প্রধান শাসক ছিলেন আলাউদ্দিন খলজি। ১৩০৫ থেকে ১৩১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লির সুলতান হিসেবে তিনি রাজত্ব করেন। আলাউদ্দিন খলজির শাসনামলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রচুর সংস্কার সাধিত হয়েছিল, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। তার অর্থনৈতিক সংস্কারগুলি মধ্যযুগীয় ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামোকে পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। নিচে তার কিছু উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা করা হলো:
১. ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা:
আলাউদ্দিন খলজি ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার পুনর্গঠন করেন। তিনি সঠিকভাবে জমির পরিমাপের মাধ্যমে কর নির্ধারণ করতেন। জমির উর্বরতা এবং উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে রাজস্ব নির্ধারিত হতো। এই সংস্কারগুলির মাধ্যমে কৃষকদের উপর থেকে অতিরিক্ত করের বোঝা কমানো হয়েছিল এবং রাজস্ব আদায়ের প্রক্রিয়া আরও কার্যকর ও সুষ্ঠু হয়েছিল।
২. বাজার নিয়ন্ত্রণ:
আলাউদ্দিন খলজি বাজার নিয়ন্ত্রণে বিশেষ মনোযোগ দেন। তিনি দিল্লির বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করেন এবং সেই মূল্য স্থায়ী রাখতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বাজারে জিনিসপত্রের মূল্য স্থায়ী রাখার জন্য তিনি সরকারী কর্মচারী নিযুক্ত করেন, যারা বাজারে পণ্যের সরবরাহ ও মূল্য পর্যবেক্ষণ করতেন। এই ব্যবস্থার ফলে সাধারণ মানুষ ন্যায্য মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে পারত এবং বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় থাকত।
৩. বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ:
আলাউদ্দিন খলজি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি দিল্লির প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলিতে সরকারী গুদাম স্থাপন করেন, যেখানে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্য মজুদ থাকত। এই গুদামগুলি থেকে সাধারণ মানুষ ন্যায্য মূল্যে পণ্য সংগ্রহ করতে পারত। এছাড়াও, তিনি বণিকদের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন যাতে তারা অতিরিক্ত লাভের আশায় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে।
৪. সেনাবাহিনী রক্ষণাবেক্ষণ:
আলাউদ্দিন খলজি তার সেনাবাহিনী রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি সেনাবাহিনীর সদস্যদের বেতন সময়মত প্রদান করতেন এবং তাদের জন্য বিশেষ ভাতা চালু করেন। এছাড়াও, তিনি সেনাবাহিনীর জন্য বিশেষ বাজার স্থাপন করেন যেখানে তারা ন্যায্য মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে পারত। এর ফলে সেনাবাহিনীর মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং তারা আরও দক্ষভাবে শাসককে সেবা করতে পারে।
৫. কর ব্যবস্থার সংস্কার:
আলাউদ্দিন খলজি কর ব্যবস্থারও সংস্কার করেন। তিনি কর আদায়ের ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকা হ্রাস করেন এবং সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে কর আদায় শুরু করেন। এর ফলে কর আদায়ের প্রক্রিয়া আরও সুষ্ঠু ও কার্যকর হয়। এছাড়াও, তিনি কর আদায়ের জন্য নতুন নতুন কর প্রবর্তন করেন, যা রাজ্যের আয় বৃদ্ধি করতে সহায়ক হয়েছিল।
৬. দাসব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ:
আলাউদ্দিন খলজি দাসব্যবস্থার উপরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। তিনি দাসদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। দাসদের সঠিকভাবে খাদ্য, বস্ত্র এবং আশ্রয়ের ব্যবস্থা করার জন্য তিনি নির্দেশ দেন। এছাড়াও, তিনি দাসদের অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেন।
৭. গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন:
আলাউদ্দিন খলজি গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি গ্রামের কৃষকদের জন্য বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করেন এবং তাদের উন্নত চাষাবাদের জন্য উৎসাহিত করেন। এছাড়াও, তিনি গ্রামে বিভিন্ন ধরনের কুটির শিল্পের প্রসার ঘটান, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে।
উপসংহার:
আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কারগুলি মধ্যযুগীয় ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামোকে একটি নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছিল। তার সংস্কারগুলি সাধারণ মানুষের জীবনের মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও, তার অর্থনৈতিক সংস্কারগুলি রাজ্যের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়েছিল। আলাউদ্দিন খলজির শাসনামলে প্রবর্তিত অর্থনৈতিক সংস্কারগুলি মধ্যযুগীয় ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।
***3) প্রশ্ন. ফিরোজ শাহ তুঘলকের বিভিন্ন সংস্কারমূলক কার্যাবলীর পরিচয় দাও। (১০/৫)
ফিরোজ শাহ তুঘলকের বিভিন্ন সংস্কারমূলক কার্যাবলীর পরিচয়:
ফিরোজ শাহ তুঘলক (১৩৫১-১৩৮৮ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন তুঘলক বংশের তৃতীয় সুলতান এবং তার শাসনামল ছিল সংস্কার ও স্থায়িত্বের জন্য উল্লেখযোগ্য। তার শাসনামলে বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং প্রশাসনিক সংস্কার চালু করা হয় যা মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। তার সংস্কারমূলক কার্যাবলী নিন্মলিখিত প্রকারে আলোচনা করা যেতে পারে:
১. কৃষি সংস্কার:
ফিরোজ শাহ তুঘলক কৃষকদের অবস্থা উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি খাল ও ক্যানেল নির্মাণ করেন যার ফলে সেচের ব্যবস্থা উন্নত হয়। দুধান খাল, গঙ্গার জমুনার সংযোগকারী ক্যানেল, এবং আরও অনেক খাল নির্মাণ করে তিনি সেচ ব্যবস্থা উন্নত করেন। এর ফলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং কৃষকদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটে।
২. রাজস্ব সংস্কার:
ফিরোজ শাহ তুঘলক রাজস্ব ব্যবস্থায়ও গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এনেছিলেন। তিনি কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি কর আদায়ের প্রথা প্রবর্তন করেন এবং তাদের উপর থেকে অতিরিক্ত করের বোঝা লাঘব করেন। ফিরোজ শাহ তুঘলক রাজস্ব আদায়ের জন্য শস্যের ১০ ভাগের ১ ভাগ কর ধার্য করেন এবং এটি বেশ কার্যকরভাবে পরিচালিত হয়।
৩. সামাজিক সংস্কার:
ফিরোজ শাহ তুঘলক সামাজিক সংস্কারেও গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বিধবা নারীদের পুনর্বিবাহের প্রথা উৎসাহিত করেন এবং দাসপ্রথা নিরসনের চেষ্টা করেন। ফিরোজ শাহ তুঘলক তাঁর শাসনামলে বহু দাস মুক্ত করেছিলেন এবং তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন। এছাড়াও, তিনি সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেন।
৪. ধর্মীয় সংস্কার:
ফিরোজ শাহ তুঘলক ইসলামের প্রতি গভীরভাবে আস্থাশীল ছিলেন এবং তিনি ধর্মীয় কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করেছিলেন। মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকা নির্মাণে উৎসাহ দিয়েছিলেন এবং ধর্মীয় পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। তার শাসনামলে বিভিন্ন ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয় যা ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৫. বিচারব্যবস্থা সংস্কার:
ফিরোজ শাহ তুঘলক বিচারব্যবস্থা সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি আদালত ব্যবস্থায় সংস্কার আনার জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করেন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেন। বিচারব্যবস্থা অধিকতর কার্যকরী করার জন্য তিনি বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যা সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথকে সুগম করে।
৬. প্রশাসনিক সংস্কার:
ফিরোজ শাহ তুঘলক প্রশাসনিক কাঠামোতেও পরিবর্তন এনেছিলেন। তিনি প্রশাসনিক বিভাগগুলোকে পুনর্গঠন করেন এবং প্রতিটি বিভাগের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নিয়োগ করেন। প্রশাসনিক কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি পায় যার ফলে শাসন ব্যবস্থার কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
৭. স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সংস্কার:
ফিরোজ শাহ তুঘলক স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রেও সংস্কারমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনি বিভিন্ন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন এবং সাধারণ জনগণের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। একই সাথে তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন এবং শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগী হন। তার শাসনামলে মাদ্রাসা ও বিদ্যালয়গুলির সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং সাধারণ মানুষের শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি পায়।
৮. শিল্প ও বাণিজ্য উন্নয়ন:
ফিরোজ শাহ তুঘলক শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নয়নে গুরুত্ব দেন। তিনি বিভিন্ন শিল্প ও কারুশিল্পের প্রসারে উদ্যোগী হন এবং শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বাণিজ্যিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি সড়ক, সেতু ও বন্দর নির্মাণ করেন। এর ফলে বাণিজ্যিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে।
৯. সমরনীতি ও প্রতিরক্ষা:
ফিরোজ শাহ তুঘলক সমরনীতি ও প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এনেছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন করেন এবং তাদের প্রশিক্ষণ ও সজ্জিতকরণের ব্যবস্থা করেন। বিভিন্ন দুর্গ ও প্রতিরক্ষা কাঠামো নির্মাণ করে তিনি সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেন এবং দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।
উপসংহার:
ফিরোজ শাহ তুঘলকের বিভিন্ন সংস্কারমূলক কার্যাবলী মধ্যযুগীয় ভারতের শাসনব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তার সংস্কারগুলো দেশ ও জনগণের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে এবং তার শাসনামলকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলে। ইতিহাসে ফিরোজ শাহ তুঘলক তার সংস্কারমূলক কার্যাবলীর জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
****4) প্রশ্ন. সুলতানি যুগের স্থাপত্য, ভাস্কর্য এবং শিল্পকলার পরিচয় দাও? 10
ভূমিকা:
সুলতানি যুগ ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামী স্থাপত্য ও সংস্কৃতির বিকাশের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। এই সময়কালে স্থাপত্য, ভাস্কর্য এবং শিল্পকলায় নতুন ধারার সংযোজন ঘটে, যা ভারতীয় ও ইসলামী সংস্কৃতির মিশ্রণে অনন্য বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। দিল্লির সুলতানরা স্থাপত্যকলায় যেমন বিশাল ও চমকপ্রদ নিদর্শন তৈরি করেন, তেমনি ভাস্কর্য ও চিত্রকলায়ও নিয়ে আসেন নতুনত্ব।
স্থাপত্য:
সুলতানি যুগে স্থাপত্যে প্রধানত ইসলামী আর্কিটেকচারের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মসজিদ, মাদ্রাসা, মাজার এবং দুর্গগুলি সুলতানি স্থাপত্যের অন্তর্ভুক্ত। উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে কুতুব মিনার, আলাই দরওয়াজা, কুতুবউদ্দিন আইবেকের নির্মিত কুয়াত-উল-ইসলাম মসজিদ ইত্যাদি।
১. কুতুব মিনার: কুতুবউদ্দিন আইবেক দ্বারা নির্মিত এই মিনারটি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ইটের মিনার। এটি ইসলামী স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ এবং এর সুন্দর কারুকাজ, শিলালিপি ও খোদাই করা আরবি লেখা একে অনন্য করে তুলেছে।
২. আলাই দরওয়াজা: আলাউদ্দিন খিলজি দ্বারা নির্মিত এই গেটটি ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামী স্থাপত্যের প্রথম নিদর্শন। এর গম্বুজ, খিলান এবং জ্যামিতিক নকশা প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর নতুন দিক নির্দেশ করে।
৩. কুয়াত-উল-ইসলাম মসজিদ: এটি দিল্লির প্রথম মসজিদ, যা কুতুবউদ্দিন আইবেকের আমলে নির্মিত। হিন্দু ও জৈন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ব্যবহার করে নির্মিত এই মসজিদটি হিন্দু ও ইসলামী স্থাপত্যের মিশ্রণে অনন্য।
ভাস্কর্য:
সুলতানি যুগে ভাস্কর্যে ইসলামী প্রভাব সুস্পষ্ট। ইসলামী শিল্পে সাধারণত মানুষের চিত্রায়ণ নিষিদ্ধ থাকায় এই সময়ে ভাস্কর্যে প্রধানত জ্যামিতিক নকশা, আরবি ক্যালিগ্রাফি ও উদ্ভিদমূর্তি স্থান পায়।
১. জ্যামিতিক নকশা: মসজিদ, মাদ্রাসা ও মাজারে জ্যামিতিক নকশা ও অলঙ্করণ প্রচলিত হয়। এই নকশাগুলি কারুকার্যময় এবং সূক্ষ্মভাবে খোদাই করা হয়, যা স্থাপত্যে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
২. আরবি ক্যালিগ্রাফি: সুলতানি যুগে ভাস্কর্যে আরবি ক্যালিগ্রাফি একটি বিশেষ স্থান দখল করে। মসজিদ ও মাজারের দেওয়ালে কোরআনের আয়াত ও অন্যান্য ধর্মীয় বাণী খোদাই করা হয়।
৩. উদ্ভিদমূর্তি: এই সময়ে উদ্ভিদমূর্তি বা ফ্লোরাল মোটিফ প্রচলিত হয়। মসজিদের মিনার ও দরজা, মাজারের গম্বুজে এই মোটিফগুলি অলঙ্করণের জন্য ব্যবহৃত হয়।
শিল্পকলা:
সুলতানি যুগে শিল্পকলায়ও ইসলামী প্রভাব দেখা যায়। চিত্রকলা, কারুকার্য ও ধাতুশিল্পে নতুন নতুন ধারার সৃষ্টি হয়।
১. চিত্রকলা: সুলতানি যুগে চিত্রকলায় পারস্য ও মধ্য এশিয়ার প্রভাব লক্ষ করা যায়। মুদ্রায়, পাণ্ডুলিপিতে এবং অন্যান্য অলঙ্করণে এই চিত্রকলার নিদর্শন দেখা যায়।
২. কারুকার্য: সুলতানি যুগে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে কারুকার্যের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। মসজিদ ও মাজারের দেয়ালে, দরজা ও জানালার ফ্রেমে কারুকার্য করা হয়।
৩. ধাতুশিল্প: এই সময়ে ধাতুশিল্পেও নতুন নতুন নকশার প্রবর্তন ঘটে। ব্রোঞ্জ ও তামার উপর খোদাই করা আরবি লিপি, জ্যামিতিক নকশা ও ফ্লোরাল মোটিফগুলি ধাতুশিল্পে নতুনত্ব আনে।
উপসংহার:
সুলতানি যুগের স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও শিল্পকলায় ইসলামী ও ভারতীয় সংস্কৃতির এক অনন্য মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। এই সময়ে নির্মিত স্থাপত্যকলা, ভাস্কর্য ও শিল্পকলা শুধুমাত্র ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের প্রতিফলন নয়, বরং সৃষ্টিশীলতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। সুলতানি যুগের এই শিল্পকর্মগুলি আজও ভারতের স্থাপত্য ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।
****5) প্রশ্ন. মুর্শিদকুলি খাঁর নেতৃত্বে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বাংলার উত্থান বর্ণনা কর। (১০ নম্বর)
মুর্শিদকুলি খাঁর নেতৃত্বে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বাংলার উত্থান:
মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার নবাব ছিলেন এবং তাঁর নেতৃত্বে বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। তিনি বাংলার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন। তাঁর সময়কালে বাংলার উত্থান ও উন্নয়ন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
১. প্রশাসনিক সংস্কার:
মুর্শিদকুলি খাঁর প্রধান কৃতিত্ব ছিল বাংলার প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠন। তিনি রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার করে বাংলার আর্থিক পরিস্থিতি মজবুত করেন। তিনি রাজস্ব আদায়ের জন্য একটি কার্যকরী ব্যবস্থা চালু করেন, যার ফলে রাজ্যের আয় বৃদ্ধি পায়। রাজস্ব আদায়কারীদের মধ্যে দুর্নীতি কমানোর জন্য তিনি জমিদার ও রাজস্ব আধিকারিকদের উপর কঠোর নজরদারি চালু করেন।
২. রাজধানী স্থানান্তর:
মুর্শিদকুলি খাঁ ঢাকার পরিবর্তে মুর্শিদাবাদকে বাংলার রাজধানী করেন। এই স্থানান্তরের ফলে মুর্শিদাবাদ বাণিজ্য, সংস্কৃতি এবং প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হয়। রাজধানী স্থানান্তরের ফলে মুর্শিদাবাদে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায় এবং এটি একটি সমৃদ্ধ শহরে পরিণত হয়।
৩. অর্থনৈতিক উন্নয়ন:
মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে বাংলার অর্থনীতি দ্রুত উন্নতি লাভ করে। বাণিজ্য ও ব্যবসার প্রসার ঘটে এবং বাংলা সমৃদ্ধিশালী হয়। তিনি কৃষির উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যার ফলে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও, তাঁত শিল্প এবং অন্যান্য হস্তশিল্পের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
৪. সামরিক শক্তি বৃদ্ধি:
মুর্শিদকুলি খাঁ তাঁর সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেন এবং সেনাবাহিনীর সংগঠনকে পুনর্গঠন করেন। তিনি একটি শক্তিশালী এবং সুসংগঠিত সেনাবাহিনী গঠন করেন, যা আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাঁর সামরিক কৌশল এবং যুদ্ধকৌশল বাংলার সামরিক শক্তিকে মজবুত করে তোলে।
৫. ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন:
মুর্শিদকুলি খাঁর শাসনামলে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য প্রচারিত হয়। তিনি বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সমন্বয় বজায় রাখার চেষ্টা করেন। তাঁর শাসনামলে বিভিন্ন মসজিদ, মন্দির ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়, যা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৬. পররাষ্ট্র নীতি:
মুর্শিদকুলি খাঁ পররাষ্ট্র নীতিতে দক্ষ ছিলেন। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে কাজ করেন। তাঁর কৌশলী পররাষ্ট্রনীতি বাংলার স্বাধীন অস্তিত্বকে বজায় রাখতে সহায়ক হয়। তিনি মুঘলদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বাংলার স্বার্থ রক্ষা করতে সক্ষম হন।
৭. প্রভাব ও উত্তরাধিকার:
মুর্শিদকুলি খাঁর নেতৃত্বে বাংলার উত্থান এবং উন্নয়ন বাংলার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাঁর শাসনামলে বাংলার রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজে যে পরিবর্তন এসেছে, তা পরবর্তী সময়ে বাংলার উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কারগুলি বাংলার সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখে।
উপসংহার:
মুর্শিদকুলি খাঁর নেতৃত্বে বাংলার উত্থান এক ঐতিহাসিক ঘটনা। তাঁর প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সামরিক এবং সাংস্কৃতিক কৃতিত্বের ফলে বাংলা একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মুর্শিদকুলি খাঁর শাসনামল বাংলার ইতিহাসে একটি স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
***6) প্রশ্ন. দিল্লির সুলতানের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে ইলতুৎমিসের কৃতিত্ব বিচার কর। (১০/৫ নম্বর)
দিল্লি সালতানাতের ইতিহাসে ইলতুৎমিস (১২০৬-১২৩৬) এক গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী শাসক হিসেবে বিবেচিত হন। তিনি কেবলমাত্র দিল্লির সুলতান নন, বরং দিল্লি সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকৃত। ইলতুৎমিসের শাসনামল এবং তার কৃতিত্বগুলি বিবেচনা করলে দেখা যায়, তার নেতৃত্বে দিল্লি সালতানাত একটি সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।
১. সিংহাসনে আরোহণ ও সুলতানাতের স্থায়িত্ব নিশ্চিতকরণ:
ইলতুৎমিসের সিংহাসনে আরোহণের সময় দিল্লি সালতানাত রাজনৈতিক এবং সামরিক সমস্যায় নিমজ্জিত ছিল। প্রথম সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের মৃত্যুর পর সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে অস্থিরতা দেখা দেয়। ইলতুৎমিস দক্ষতার সাথে এই অস্থিরতা দমন করেন এবং সালতানাতের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করেন।
২. রাজ্য সম্প্রসারণ ও শাসনব্যবস্থা সুসংহতকরণ:
ইলতুৎমিস দক্ষ শাসক ছিলেন এবং তিনি দিল্লি সালতানাতের সীমানা উল্লেখযোগ্যভাবে সম্প্রসারণ করেন। বাংলার স্বাধীন শাসক গুলির বিরুদ্ধেও সফল অভিযান চালিয়ে তিনি পূর্বদিকে সালতানাতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া, রাজস্থানের মেওয়ার এবং গুজরাটেও সফল অভিযান পরিচালনা করে তিনি সালতানাতের ক্ষমতা সুসংহত করেন।
৩. মঙ্গোল আক্রমণ প্রতিরোধ:
ইলতুৎমিসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব ছিল মঙ্গোল আক্রমণের প্রতিরোধ। চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মঙ্গোলরা যখন ভারতবর্ষ আক্রমণ করে, ইলতুৎমিস দক্ষতার সাথে তাদের প্রতিরোধ করেন। তিনি দিল্লির প্রতিরক্ষা সুসংহত করেন এবং মঙ্গোলদের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়ে কূটনৈতিক চাতুর্যের মাধ্যমে তাদের মোকাবিলা করেন।
৪. প্রশাসনিক সংস্কার ও স্থায়িত্ব:
ইলতুৎমিস প্রশাসনিক ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করেন। তিনি 'ইক্তা' ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন, যা পরে দিল্লি সালতানাতের প্রশাসনিক কাঠামোর ভিত্তি হয়ে ওঠে। এই ব্যবস্থায় জমি রাজস্বের ভিত্তিতে সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে ভাগ করা হত, যা প্রশাসনের স্থায়িত্ব এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধি করেছিল।
৫. সাংস্কৃতিক ও স্থাপত্যিক কৃতিত্ব:
ইলতুৎমিস দিল্লি শহরকে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন। তিনি বহু স্থাপত্য নিদর্শন নির্মাণ করেন, যার মধ্যে কুতুব মিনারের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন এবং সুলতান গারি সমাধি নির্মাণ করেন। তার শাসনামলে দিল্লি একটি উন্নত সাংস্কৃতিক এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
৬. মুদ্রা সংস্কার:
ইলতুৎমিস মুদ্রা ব্যবস্থায়ও উল্লেখযোগ্য সংস্কার করেন। তিনি 'তঙ্কা' নামে একটি রৌপ্য মুদ্রা প্রচলন করেন, যা পরবর্তীকালে দিল্লি সালতানাতের অর্থনীতির ভিত্তি হয়ে ওঠে। তার মুদ্রা সংস্কার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটায়।
৭. উত্তরাধিকার ব্যবস্থা:
ইলতুৎমিস তার শাসনকালের শেষে তার কন্যা রাযিয়া সুলতানাকে উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেন। যদিও তার শাসনকাল খুব দীর্ঘস্থায়ী ছিল না, তবে রাযিয়া সুলতানা দিল্লি সালতানাতের প্রথম মহিলা শাসক হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
উপসংহার:
ইলতুৎমিসের শাসনামল ছিল দিল্লি সালতানাতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। তার প্রশাসনিক দক্ষতা, সামরিক কৌশল, এবং সংস্কারমূলক কাজগুলি দিল্লি সালতানাতকে একটি শক্তিশালী এবং সুসংহত সাম্রাজ্যে পরিণত করেছিল। ইলতুৎমিসকে দিল্লি সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা একেবারেই যথার্থ, কারণ তার শাসনামলে সালতানাতের ভিত্তি সুদৃঢ় হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকার উপযোগী হয়ে ওঠে। তার কৃতিত্বগুলি শুধুমাত্র সমসাময়িক সময়ে নয়, বরং ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়ও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে।
UNIT-2
****7) প্রশ্ন. আকবর প্রচারিত 'দ্বীন-ই-ইলাহি' কি নতুন ধর্ম মত ছিল? (৫ নম্বর)
আকবর প্রচারিত 'দ্বীন-ই-ইলাহি' সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই বুঝতে হবে এটি আদতে কি ছিল এবং এর উদ্দেশ্য কি ছিল। আকবরের 'দ্বীন-ই-ইলাহি' বা 'দেবতার ধর্ম' এক নতুন ধর্ম মত ছিল না বরং এটি ছিল একটি দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টা যা বিভিন্ন ধর্মের মূলনীতিকে একত্রিত করে এক সার্বজনীন ধর্মের ধারণা তৈরি করা।
আকবরের ধর্মীয় সহনশীলতা:
আকবর মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট ছিলেন এবং তার শাসনকাল (১৫৫৬-১৬০৫) ছিল ধর্মীয় সহনশীলতার জন্য পরিচিত। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে তার বিশাল সাম্রাজ্যে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বাস করত এবং একমাত্র ধর্মীয় সহনশীলতা ও সমঝোতার মাধ্যমেই এই বিশাল সাম্রাজ্যকে একত্রিত রাখা সম্ভব। এই উপলব্ধি থেকেই আকবর বিভিন্ন ধর্মের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন করেন এবং তিনি নিজে বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের সাথে আলোচনা করতেন।
দ্বীন-ই-ইলাহি প্রতিষ্ঠা:
১৫৮২ সালে আকবর 'দ্বীন-ই-ইলাহি' প্রতিষ্ঠা করেন। এটি এক ধরনের আধ্যাত্মিক আন্দোলন ছিল যা বিভিন্ন ধর্মের মূলনীতিকে একত্রিত করে এক সার্বজনীন নৈতিকতার উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা হয়েছিল। আকবর নিজেই এই ধর্মের প্রধান প্রচারক ছিলেন এবং তিনি তার নিকটবর্তী অনুগামী ও সভাসদদের মধ্যে এই মতবাদ প্রচার করেছিলেন।
দ্বীন-ই-ইলাহির মূলনীতি:
'দ্বীন-ই-ইলাহি'র মূলনীতিগুলি ছিল নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে। এতে বিভিন্ন ধর্মের মৌলিক দিকগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে প্রধান কিছু মূলনীতি হল:
1. একেশ্বরবাদ: 'দ্বীন-ই-ইলাহি'তে একটি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ধারণা ছিল, যা ইসলামের তাওহীদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। 2. সহনশীলতা: বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের প্রতি সহনশীলতা ও সমঝোতা প্রদর্শন। 3. ন্যায়পরায়ণতা: সমাজে ন্যায়পরায়ণতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। 4. সাধুতা ও পবিত্রতা: ব্যক্তিগত জীবন ও আচরণে সাধুতা ও পবিত্রতা বজায় রাখা।
দ্বীন-ই-ইলাহির প্রভাব:
'দ্বীন-ই-ইলাহি' বিশেষভাবে আকবরের সভাসদ ও অনুগামীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে এর বিশেষ প্রভাব পরেনি। আকবরের মৃত্যুর পর এই মতবাদ তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি এবং ক্রমেই হারিয়ে যায়। কিন্তু আকবরের এই প্রচেষ্টা তার ধর্মীয় সহনশীলতা ও সাম্প্রদায়িক ঐক্যের প্রতি প্রতিশ্রুতির প্রতীক হিসেবে রয়ে গেছে।
সমালোচনা ও বিতর্ক:
অনেক ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় পণ্ডিত 'দ্বীন-ই-ইলাহি'র প্রাসঙ্গিকতা ও কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্ক করেছেন। কিছু সমালোচক মনে করেন যে এটি ছিল আকবরের রাজনৈতিক কৌশলের একটি অংশ, যার মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সমর্থন পেতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে, কিছু পণ্ডিত মনে করেন যে এটি ছিল আকবরের আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক অনুসন্ধানের ফলাফল।
উপসংহার:
'দ্বীন-ই-ইলাহি' আকবরের এক অসাধারণ প্রচেষ্টা ছিল যা ধর্মীয় সহনশীলতা ও সাম্প্রদায়িক ঐক্যের এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। যদিও এটি নতুন একটি ধর্ম মত ছিল না, তবে এটি বিভিন্ন ধর্মের মূলনীতিকে একত্রিত করে এক সার্বজনীন আধ্যাত্মিক ধারণা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল। আকবরের এই প্রচেষ্টা তার ধর্মীয় সহনশীলতা ও সমঝোতার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
****8) প্রশ্ন.আকবরের রাজপুত নীতির বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো এবং কীভাবে সেগুলি আকবরকে তার সাম্রাজ্য গঠনে সাহায্য করেছিল? (১০ নম্বর)
ভূমিকা:
মুঘল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে পরিচিত। তিনি তার রাজত্বকালে একাধিক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নীতি গ্রহণ করেন, যা তার সাম্রাজ্যকে সুসংহত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আকবরের রাজপুত নীতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কারণ এটি তার সাম্রাজ্যকে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল করতে সহায়ক ছিল। এই নীতির বৈশিষ্ট্যগুলি এবং সেগুলির প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
রাজপুত নীতির বৈশিষ্ট্য:
১. বিবাহের মাধ্যমে জোটবদ্ধতা: আকবর রাজপুত রাজকন্যাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তাদের সাথে রাজনৈতিক জোট গড়ে তুলেছিলেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল রাজপুত রাজা ভগবান দাসের কন্যা জোধা বাইকে বিবাহ। এই বিবাহ রাজনৈতিক সম্পর্ককে সুদৃঢ় করেছিল এবং রাজপুত শাসকদের আকবরের প্রতি আনুগত্য নিশ্চিত করেছিল।
২. আনুগত্যের বিনিময়ে স্বায়ত্তশাসন: আকবর রাজপুত শাসকদের তাদের রাজ্যের উপর স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেন, বিনিময়ে তারা আকবরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। এই ব্যবস্থা রাজপুতদের সন্তুষ্ট রাখত এবং তারা আকবরের সামরিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে সহায়তা করত।
৩. রাজপুত শাসকদের উচ্চপদে নিয়োগ: আকবর রাজপুত শাসকদের তার প্রশাসনের উচ্চপদে নিয়োগ করেন। উদাহরণস্বরূপ, রাজা মান সিং আকবরের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন। এই পদক্ষেপ রাজপুতদের মধ্যে আস্থা বৃদ্ধি করে এবং তাদের আকবরের প্রতি অনুগত রাখে।
৪. ধর্মীয় সহনশীলতা: আকবর সকল ধর্মের প্রতি সহনশীল ছিলেন এবং রাজপুত শাসকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন। তিনি হিন্দু মন্দির পুনর্নির্মাণে সহায়তা করেন এবং হিন্দুদের উপাসনার স্বাধীনতা প্রদান করেন। এই নীতি রাজপুতদের মধ্যে বিশ্বাস এবং আনুগত্য বাড়িয়ে তোলে।
আকবরের রাজপুত নীতির প্রভাব:
১. সাম্রাজ্যের বিস্তার: রাজপুতদের সাথে মৈত্রীপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে আকবর তার সাম্রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত করতে সক্ষম হন। রাজপুত শাসকরা তার সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণ করত এবং নতুন অঞ্চল জয়ে সহায়তা করত।
২. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: রাজপুত নীতির ফলে আকবরের সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে। রাজপুত শাসকরা বিদ্রোহ না করে বরং আকবরের শাসন ব্যবস্থার অংশ হয়ে ওঠে, যা সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে।
৩. সামাজিক সংহতি: আকবরের ধর্মীয় সহনশীলতা এবং বিবাহের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন রাজপুত ও মুঘলদের মধ্যে সামাজিক সংহতি তৈরি করে। এই সংহতি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখতে সহায়ক ছিল।
৪. প্রশাসনিক দক্ষতা: রাজপুত শাসকদের উচ্চপদে নিয়োগ আকবরের প্রশাসনকে দক্ষ ও কার্যকর করে তোলে। রাজপুতরা তাদের স্থানীয় জ্ঞান এবং প্রশাসনিক দক্ষতা দিয়ে সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থাকে সুসংহত করতে সহায়তা করত।
উপসংহার:
আকবরের রাজপুত নীতি তার সাম্রাজ্য গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বিবাহের মাধ্যমে রাজনৈতিক জোট, স্বায়ত্তশাসনের বিনিময়ে আনুগত্য, রাজপুত শাসকদের উচ্চপদে নিয়োগ এবং ধর্মীয় সহনশীলতা আকবরের শাসন ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল ও কার্যকর করেছিল। এই নীতিগুলি আকবরের সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত এবং সুসংহত করতে সহায়ক ছিল। আকবরের এই প্রগতিশীল নীতিগুলি তাকে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে পরিচিত করেছে।
***9) প্রশ্ন. জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে নুরজাহানের ভূমিকা মূল্যায়ন কর (৫ নম্বর)
জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল (১৬০৫-১৬২৭) মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে নুরজাহান, যার আসল নাম মেহের উন নিসা, জাহাঙ্গীরের প্রিয় রানি এবং একজন অত্যন্ত ক্ষমতাধর নারী হিসাবে আবির্ভূত হন। তাঁর প্রভাব এবং ভূমিকা মুঘল প্রশাসন, সংস্কৃতি, এবং রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
১. নুরজাহানের ক্ষমতা এবং প্রভাব:
নুরজাহান জাহাঙ্গীরের হৃদয়ে এবং মুঘল রাজপ্রাসাদে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করেছিলেন। তিনি শুধুমাত্র সম্রাটের রানি ছিলেন না, বরং কার্যত সম্রাটের সঙ্গে রাজ্য পরিচালনা করতেন। জাহাঙ্গীরের স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার কারণে, নুরজাহান অনেক সময় রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতেন।
২. রাজনৈতিক প্রভাব:
নুরজাহান রাজনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণ করতেন এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। তিনি তার পরিবারকে উচ্চপদস্থ অবস্থানে অধিষ্ঠিত করেন, বিশেষত তার ভাই আসফ খানের মাধ্যমে। আসফ খান মুঘল সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং তাঁর মেয়ে মুমতাজ মহল ছিলেন সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী।
৩. সামরিক এবং কূটনৈতিক দক্ষতা:
নুরজাহান সামরিক কৌশল এবং কূটনীতিতেও দক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন। ১৬২২ সালে, তিনি তার শত্রুদের বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন এবং বিজয় লাভ করেন। তাঁর কূটনৈতিক দক্ষতা মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানা রক্ষা করতে সহায়ক ছিল।
৪. সংস্কৃতি এবং শিল্পকলায় অবদান:
নুরজাহান একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং তিনি শিল্পকলার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় মুঘল শিল্প, স্থাপত্য, এবং বাগান নির্মাণে নতুন মাত্রা যোগ হয়। তাঁর নির্দেশনায় নির্মিত শিরি বাগ এবং ইত্তিমাদ-উদ-দৌলার সমাধি মুঘল স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন।
৫. অর্থনৈতিক অবদান:
নুরজাহান অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও অবদান রাখেন। তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যা মুঘল সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নে সহায়ক হয়েছিল। তাঁর নীতি এবং পদক্ষেপগুলি মুঘল সাম্রাজ্যের আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
৬. নারীদের ক্ষমতায়ন:
নুরজাহানের রাজনীতি এবং প্রশাসনে সক্রিয় অংশগ্রহণ নারীদের ক্ষমতায়নের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। তাঁর জীবন এবং কাজ থেকে মুঘল যুগের নারীরা প্রেরণা পেয়েছিল এবং তা সমাজে নারীদের অবস্থানের পরিবর্তনে সহায়ক হয়েছিল।
উপসংহার:
জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে নুরজাহানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুমুখী ছিল। তিনি শুধুমাত্র একজন রানি ছিলেন না, বরং মুঘল সাম্রাজ্যের একটি শক্তিশালী স্তম্ভ ছিলেন। তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা, কূটনৈতিক কৌশল, সংস্কৃতি এবং শিল্পকলার প্রতি আগ্রহ, এবং অর্থনৈতিক অবদানের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। নুরজাহানের জীবনী এবং কাজ মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছে এবং তা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে।
*****10) প্রশ্ন. শেরশাহ শুধুমাত্র একজন উদ্ভাবক ছিলেন না। তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল সরকারী প্রশাসন যন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত ও দক্ষ করে তোলা - তুমি কি এই বক্তব্যের সাথে একমত? (১০নম্বর)
শেরশাহ সুরি, যিনি শের খান নামেও পরিচিত, মধ্যযুগের ভারতের অন্যতম প্রতিভাবান এবং দূরদর্শী শাসক ছিলেন। তার শাসনকাল মাত্র পাঁচ বছর হলেও, তিনি যে সংস্কার ও উদ্ভাবন করেছিলেন, তা ভারতীয় ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। "শেরশাহ শুধুমাত্র একজন উদ্ভাবক ছিলেন না। তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল সরকারী প্রশাসন যন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত ও দক্ষ করে তোলা" এই বক্তব্যের সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত।
প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ:
শেরশাহ প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য অসংখ্য পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি প্রশাসনের সকল স্তরে সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেন এবং দুর্নীতি রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তার সময়ে কর সংগ্রহ প্রক্রিয়াকে সুসংগঠিত করা হয়েছিল এবং কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি কর সংগ্রহ করা হত, যা মধ্যস্থতাকারীদের ক্ষমতা হ্রাস করেছিল।
শেরশাহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল 'পাট্টা' এবং 'কবুলিয়ত' প্রথা প্রবর্তন। 'পাট্টা' ছিল কৃষকদের জমির পরিমাপ এবং করের পরিমাণ নির্ধারণ করার জন্য একটি নথি এবং 'কবুলিয়ত' ছিল কৃষকদের সাথে সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি, যা কর সংগ্রহ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও সুবিন্যস্ত করে তোলে।
সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি:
শেরশাহের শাসনকালে সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়। তিনি ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে সড়ক নির্মাণ করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো 'গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড' যা তৎকালীন বাংলার সোনারগাঁ থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই সড়ক ব্যবস্থার উন্নতির ফলে বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটে এবং প্রশাসনিক কাজকর্মে গতি আসে।
মুদ্রা ও অর্থনীতি:
শেরশাহের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার। তিনি রূপার মুদ্রা 'রুপি' চালু করেন, যা পরবর্তীতে মুঘল ও ব্রিটিশ আমলেও প্রচলিত ছিল। এই মুদ্রা ব্যবস্থার মাধ্যমে বাণিজ্যে স্বচ্ছতা আসে এবং অর্থনীতির উন্নতি ঘটে। এছাড়া তিনি সোনার মুদ্রা 'মুহর' এবং তামার মুদ্রাও চালু করেন, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে লেনদেন সহজতর করে।
বিচারব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলা:
শেরশাহের শাসনকালে বিচারব্যবস্থা এবং আইনশৃঙ্খলারও উন্নতি হয়। তিনি বিচারব্যবস্থাকে কার্যকর ও নিরপেক্ষ করার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে 'কোতোয়ালি' প্রথা চালু করেন, যেখানে স্থানীয় কর্মকর্তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধীদের শাস্তি প্রদান করতেন। এই প্রথার ফলে সমাজে অপরাধপ্রবণতা কমে আসে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তার বোধ বৃদ্ধি পায়।
সামরিক সংস্কার:
শেরশাহের সামরিক সংস্কারও প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি সেনাবাহিনীকে আধুনিক ও সুসংগঠিত করতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সেনাবাহিনীতে নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও বেতন ব্যবস্থাকে সুসংগঠিত করেন এবং যুদ্ধকালীন সময়ে সেনাবাহিনীর কার্যকরী ভূমিকা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও রসদ সরবরাহের ব্যবস্থাও করেন।
উপসংহার:
শেরশাহ সুরি শুধুমাত্র একজন উদ্ভাবক ছিলেন না, তিনি একজন দূরদর্শী শাসক ছিলেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি করা। তার সময়ে প্রবর্তিত বিভিন্ন সংস্কার ও উদ্ভাবনগুলি প্রশাসনের কার্যকারিতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করেছে এবং পরবর্তীতে মুঘল শাসনের জন্য একটি দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করেছে। তাই, বলা যায় শেরশাহের মূল উদ্দেশ্য ছিল সরকারী প্রশাসন যন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত ও দক্ষ করে তোলা, যা তিনি সফলভাবে বাস্তবায়িত করেছিলেন।
UNIT-3
******11) প্রশ্ন. আঞ্চলিক রাজ্য হিসেবে মহীশূর রাজ্যের উৎপত্তি আলোচনা কর। (১০নম্বর)
আঞ্চলিক রাজ্য হিসেবে মহীশূর রাজ্যের উৎপত্তি:
মহীশূর রাজ্য বা মাইসোর, বর্তমান কর্ণাটকের একটি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ এলাকা, যার উৎপত্তি এবং বিকাশ আঞ্চলিক রাজ্য হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহীশূরের ইতিহাস মূলত হোয়াদিয়ার রাজবংশের সাথে সম্পর্কিত, যারা দীর্ঘ সময় ধরে এই রাজ্যের শাসক ছিলেন। ১৩৯৯ সালে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধীনে মাইসোর একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর পরের ইতিহাসে মহীশূর রাজ্য ক্রমবর্ধমান সামরিক ও সাংস্কৃতিক শক্তির প্রতীক হয়ে ওঠে।
হোয়াদিয়ার রাজবংশের উত্থান:
মহীশূরের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচিত হোয়াদিয়ার রাজবংশ ১৩৯৯ সালে রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করে। হোয়াদিয়ার রাজারা মহীশূরকে একটি শক্তিশালী এবং সুসংগঠিত রাজ্যে পরিণত করেন। প্রথম হোয়াদিয়ার রাজা যদুরায়া ও তার উত্তরসূরীরা মহীশূরের সামরিক এবং প্রশাসনিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পতনের পর মহীশূর রাজ্য স্বাধীনভাবে শাসিত হতে থাকে এবং নিজেদের সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
শাসনব্যবস্থা এবং সামরিক শক্তি:
মহীশূর রাজ্যের শাসনব্যবস্থা ছিল শক্তিশালী এবং সুসংগঠিত। রাজারা নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সামরিক বাহিনীকে সুসংগঠিত করেন এবং উন্নত অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করেন। ১৬৫৯ সালে রাজারাম হোয়াদিয়ার মহীশূর রাজ্যের সামরিক শক্তি বাড়ানোর লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে, হায়দার আলি এবং তার পুত্র টিপু সুলতান মহীশূরের সামরিক শক্তিকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। তাদের সময়ে মহীশূর রাজ্য ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
টিপু সুলতানের শাসন:
টিপু সুলতানের শাসনকাল মহীশূর রাজ্যের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তিনি তার পিতার মতোই মহীশূরের সামরিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি সাধন করেন। টিপু সুলতান বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেন। তার শাসনামলে মহীশূর একটি শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধ রাজ্যে পরিণত হয়। তবে ১৭৯৯ সালে শ্রীরঙ্গপত্তম যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হয়ে তার শাসন শেষ হয়।
ব্রিটিশ আমল এবং হোয়াদিয়ার রাজত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা:
টিপু সুলতানের পতনের পর মহীশূর রাজ্য ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে। তবে ব্রিটিশরা হোয়াদিয়ার রাজবংশকে আবারও ক্ষমতায় বসায় এবং তারা ব্রিটিশদের অধীনে স্বায়ত্তশাসিত শাসক হিসেবে কাজ করে। মহীশূর রাজ্য ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এখানে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন হয়। মহীশূর রাজ্যের রাজারা শিক্ষাব্যবস্থা, রেলপথ, এবং অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
সাংস্কৃতিক উন্নয়ন:
মহীশূর রাজ্যের ইতিহাস কেবল সামরিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও সমৃদ্ধ। মহীশূরের রাজারা শিল্প, সংস্কৃতি, এবং শিক্ষার উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মহীশূরের দরবারে সাহিত্য, সঙ্গীত, এবং চিত্রকলা বিকাশ লাভ করে। মহীশূর প্যালেস ভারতের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়।
উপসংহার:
মহীশূর রাজ্যের উৎপত্তি এবং বিকাশ আঞ্চলিক রাজ্য হিসেবে ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। হোয়াদিয়ার রাজবংশের শাসনামল, টিপু সুলতানের শাসন, এবং ব্রিটিশ আমলে মহীশূরের পুনঃপ্রতিষ্ঠা—এই সমস্ত কিছুই মহীশূরের ইতিহাসকে গঠন করেছে। সামরিক, রাজনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে মহীশূর রাজ্য ভারতের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে রেখেছে।
*****12) প্রশ্ন. আঞ্চলিক রাজ্য হিসেবে হায়দ্রাবাদ রাজ্যের উৎপত্তি বা উত্থান সম্পর্কে আলোচনা কর। (৫নম্বর)
প্রাচীন ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট:
হায়দ্রাবাদ রাজ্যের উৎপত্তি ও উত্থান এক দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাসের ফল। এটি দক্ষিণ ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য এবং এর ইতিহাস মূলত মুঘল সাম্রাজ্য, মারাঠা সাম্রাজ্য, এবং ব্রিটিশ শাসনের সাথে গভীরভাবে যুক্ত। হায়দ্রাবাদের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কুতুবশাহী বংশের সুলতান কুলি কুতুব মুলুক (Quli Qutb Mulk) উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
কুতুবশাহী বংশের শাসন:
১৫১৮ সালে, কুলি কুতুব মুলুক গোলকোন্ডায় কুতুবশাহী বংশের শাসন শুরু করেন। তার নেতৃত্বে হায়দ্রাবাদ একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ রাজ্যে পরিণত হয়। এই সময়ে গোলকোন্ডা তার হীরার খনির জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এই হীরাগুলি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হত, যা রাজ্যের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে তোলে।
মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্তি:
১৬৮৭ সালে, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব হায়দ্রাবাদ দখল করেন এবং কুতুবশাহী বংশের অবসান ঘটে। হায়দ্রাবাদ তখন মুঘল সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময়ে, হায়দ্রাবাদ একটি সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হতে থাকে।
নিজামের উত্থান:
১৭২৪ সালে, মুঘল সাম্রাজ্যের দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে, আসাফ জাহ প্রথম নিজাম-উল-মুল্ক হায়দ্রাবাদের প্রথম নিজাম হিসেবে ক্ষমতা দখল করেন। নিজামের শাসনকালে হায়দ্রাবাদ একটি শক্তিশালী এবং স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আসাফ জাহ বংশের শাসনকালে হায়দ্রাবাদ তার স্বকীয়তা বজায় রেখে একটি উন্নত এবং সমৃদ্ধ রাজ্যে পরিণত হয়।
ব্রিটিশ শাসন ও হায়দ্রাবাদ:
১৮০০ সালের প্রথম দিকে, নিজাম ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যার ফলে হায়দ্রাবাদ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে একটি করদ রাজ্য হিসেবে পরিগণিত হয়। ব্রিটিশ শাসনের সময়, হায়দ্রাবাদ তার আভ্যন্তরীণ স্বকীয়তা বজায় রাখলেও, ব্রিটিশদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বাড়তে থাকে।
স্বাধীনতার পরবর্তী পরিস্থিতি:
ভারতের স্বাধীনতার পর, ১৯৪৭ সালে, হায়দ্রাবাদ রাজ্য ভারতীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রশ্নে একটি সংকটের সম্মুখীন হয়। নিজাম হায়দ্রাবাদকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করতে চান, কিন্তু ভারত সরকার এই প্রস্তাবে সম্মতি দেয়নি। ১৯৪৮ সালে, ভারত সরকার "অপারেশন পলো" চালিয়ে হায়দ্রাবাদ দখল করে এবং রাজ্যটিকে ভারতের সাথে যুক্ত করে।
সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব:
হায়দ্রাবাদ তার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত। এখানকার মুঘল স্থাপত্য, কুতুবশাহী ও নিজাম শাসকদের নির্মিত অজস্র ঐতিহাসিক স্থাপনা, যেমন চারমিনার, গোলকোন্ডা দুর্গ, ফalaknuma প্রাসাদ, ইত্যাদি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এছাড়া, হায়দ্রাবাদ তার রন্ধনশৈলী, বিশেষ করে হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানির জন্য বিখ্যাত।
অর্থনৈতিকভাবে, হায়দ্রাবাদ দক্ষিণ ভারতের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। তথ্যপ্রযুক্তি, ঔষধ শিল্প, এবং চলচ্চিত্র শিল্পে হায়দ্রাবাদ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। এই শহরে অবস্থিত হাইটেক সিটি (HITEC City) এবং রাইসিনা হিল হায়দ্রাবাদকে ভারতের অন্যতম প্রধান প্রযুক্তি হাব হিসেবে পরিচিত করেছে।
উপসংহার:
হায়দ্রাবাদের উৎপত্তি ও উত্থান ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কুতুবশাহী, মুঘল এবং নিজামের শাসনকালে হায়দ্রাবাদ একটি শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধ রাজ্যে পরিণত হয়। স্বাধীন ভারতের অংশ হিসেবে, হায়দ্রাবাদ আজও তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জন্য পরিচিত, এবং এটি একটি প্রধান অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত কেন্দ্র হিসেবে উন্নত হয়েছে।
*****13) প্রশ্ন. শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠা শক্তির উত্থানকে তুমি কিভাবে ব্যাখ্যা করবে? (৫নম্বর)
শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠা শক্তির উত্থান:
শিবাজী ভোঁসলে, যিনি শিবাজী মহারাজ নামেও পরিচিত, ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং তার নেতৃত্বে মারাঠা শক্তির উত্থান ঘটে। শিবাজীর নেতৃত্ব গুণাবলি, সামরিক কৌশল, এবং প্রশাসনিক দক্ষতা মারাঠা সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করতে সহায়তা করে। মারাঠা শক্তির উত্থানকে বিভিন্ন দিক থেকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
শিবাজীর নেতৃত্ব গুণাবলি:
শিবাজী ছিলেন একজন মহান নেতা ও দেশপ্রেমিক। তিনি নিজের রাজ্য এবং প্রজাদের রক্ষা করতে সর্বদা প্রস্তুত ছিলেন। শিবাজীর মধ্যে ছিল অসীম সাহস, ধৈর্য, এবং দূরদর্শিতা। তিনি তার সৈন্যদের অনুপ্রাণিত করতে এবং তাদের মনোবল বাড়াতে পারতেন। তার অসাধারণ নেতৃত্ব গুণাবলি মারাঠা সাম্রাজ্যকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সহায়ক হয়।
সামরিক কৌশল
:
শিবাজীর সামরিক কৌশল অত্যন্ত উন্নত ও যুগোপযোগী ছিল। তিনি গেরিলা যুদ্ধ কৌশল ব্যবহার করতেন, যা তাকে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ী হতে সাহায্য করেছিল। শিবাজী তার সামরিক বাহিনীকে ছোট ছোট দলগুলিতে ভাগ করে তাদেরকে দ্রুত এবং আকস্মিক হামলার জন্য প্রস্তুত করতেন। এ কৌশল মারাঠা সৈন্যদেরকে মুঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বড় ধরনের সুবিধা দেয়।
প্রশাসনিক দক্ষতা:
শিবাজীর প্রশাসনিক দক্ষতা তার শাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলে। তিনি একটি সুসংগঠিত প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলেন, যা তার সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নে সহায়ক ছিল। শিবাজী তার রাজ্যের প্রতিটি অঞ্চলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং জনগণের কল্যাণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি কর ব্যবস্থা পুনর্গঠন করেন এবং প্রজাদের ওপর করের বোঝা কমান, যা তার জনপ্রিয়তাকে বাড়িয়ে দেয়।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐক্য:
শিবাজী হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি মন্দির এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পুনর্নির্মাণ করেন এবং হিন্দু সংস্কৃতির প্রচারে কাজ করেন। শিবাজীর নেতৃত্বে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা একত্রিত হয়ে মারাঠা সাম্রাজ্যের শক্তি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়।
শিবাজীর বীরত্বপূর্ণ কার্যাবলি:
শিবাজীর বীরত্বপূর্ণ কার্যাবলি মারাঠা সাম্রাজ্যের উত্থানে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তিনি তার শত্রুদের বিরুদ্ধে অসংখ্য যুদ্ধজয় করেন এবং বিভিন্ন দুর্গ দখল করেন। শিবাজীর বীরত্বপূর্ণ কার্যাবলি এবং তার সাহসিকতা মারাঠা সৈন্যদেরকে অনুপ্রাণিত করে এবং তাদের মনোবল বৃদ্ধি করে।
উপসংহার:
শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠা শক্তির উত্থান ছিল তার অসাধারণ নেতৃত্ব গুণাবলি, সামরিক কৌশল, প্রশাসনিক দক্ষতা, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐক্য, এবং বীরত্বপূর্ণ কার্যাবলির ফল। শিবাজীর দূরদর্শিতা ও দৃঢ়তা মারাঠা সাম্রাজ্যকে একটি শক্তিশালী ও সুসংগঠিত সাম্রাজ্যে পরিণত করে। তার শাসনকালে মারাঠা সাম্রাজ্য শুধুমাত্র সামরিক শক্তিতেই নয়, প্রশাসনিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও উন্নতি লাভ করে। শিবাজী মহারাজ আজও ভারতীয় ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ও প্রেরণাদায়ক ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্মরণীয়।
UNIT-4
*****14) প্রশ্ন. মুঘল আমলে শিল্প ও স্থাপত্য সম্বন্ধে একটি সংক্ষিপ্ত টাকা লেখ। ( ১০নম্বর)
Ans:মুঘল সাম্রাজ্য ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এক স্বর্ণযুগ। ১৫২৬ সালে বাবরের নেতৃত্বে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয় এবং ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত তা স্থায়ী ছিল। এই সময়কালে, মুঘল আমলে শিল্প ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে বিশাল উন্নতি ও বৈচিত্র্য দেখা যায়, যা ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থাপত্য:
মুঘল স্থাপত্যের মূল বৈশিষ্ট্য হল তার বর্ণনা ও ভাস্কর্যের জাঁকজমকপূর্ণ ব্যবহার। মুঘল স্থাপত্যের মধ্যে ইসলামী স্থাপত্যের প্রভাব এবং ভারতীয় স্থাপত্যের মিশ্রণ স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়।
তাজমহল:
মুঘল স্থাপত্যের সর্বাধিক পরিচিত নিদর্শন হল তাজমহল। এটি সম্রাট শাহজাহান তার প্রিয় স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মরণে নির্মাণ করেন। তাজমহল সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি একটি স্থাপত্য-কীর্তি, যা তার অসাধারণ সৌন্দর্য ও কারুকার্যের জন্য বিশ্ববিখ্যাত। এর কেন্দ্রীয় গম্বুজ, চারটি মিনার এবং মোজাইক কাজ মুঘল স্থাপত্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য বহন করে।
লাল কিলা:
আরেকটি উল্লেখযোগ্য মুঘল স্থাপত্য হল লাল কিলা। সম্রাট শাহজাহান দিল্লিতে এই দুর্গটি নির্মাণ করেন। লাল বেলে পাথর দিয়ে নির্মিত এই দুর্গটি তার অমর স্থাপত্যশৈলীর জন্য প্রসিদ্ধ। দুর্গের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সুন্দর ভবন ও প্রাসাদ রয়েছে, যেমন দিওয়ান-ই-আম এবং দিওয়ান-ই-খাস, যেখানে সম্রাট তার দরবার করতেন।
জামা মসজিদ:
দিল্লির জামা মসজিদও মুঘল স্থাপত্যের একটি অসাধারণ উদাহরণ। এটি ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় মসজিদ এবং শাহজাহানের আমলে নির্মিত। বিশাল আকৃতির এই মসজিদটি তার তিনটি বিশাল গম্বুজ ও দুইটি উঁচু মিনারের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছে।
চিত্রকলা:
মুঘল আমলে চিত্রকলার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়। মুঘল চিত্রকলা ছিল একটি অনন্য শৈলী, যা পারস্য, তুর্কি ও ভারতীয় চিত্রকলার সংমিশ্রণ।
মিনি-চিত্র:
মুঘল মিনি-চিত্র বা মিনিয়েচার পেইন্টিং ছিল খুবই জনপ্রিয়। সম্রাট আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের শাসনামলে মিনি-চিত্রের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এই চিত্রকলায় প্রধানত মহাকাব্য, রাজকীয় জীবনধারা, যুদ্ধের দৃশ্য এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য চিত্রিত করা হতো। মিনি-চিত্রের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল আকবরনামা, যেটিতে সম্রাট আকবরের জীবনের বিভিন্ন ঘটনার চিত্রায়ণ করা হয়েছে।
পোর্ট্রেট চিত্র:
মুঘল চিত্রকলায় পোর্ট্রেট চিত্রও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সম্রাট ও তাদের পরিবারবর্গের পোর্ট্রেট চিত্র অঙ্কন করা হতো, যা রাজকীয় ক্ষমতা ও ঐশ্বর্য প্রদর্শন করতো। এই ধরনের চিত্রকলায় চিত্রশিল্পীরা বিভিন্ন জটিল ও সূক্ষ্ম কারুকাজের মাধ্যমে চরিত্রের ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলতেন।
বস্ত্রশিল্প:
মুঘল আমলে বস্ত্রশিল্পও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। মুঘল বস্ত্রশিল্পে মূলত রেশম, সুতির কাপড় এবং জরির কাজ ব্যবহার করা হতো। মুঘল শাসকেরা নিজেদের জন্য অত্যন্ত বিলাসবহুল পোশাক পরিধান করতেন, যা তাদের আভিজাত্য ও ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো।
জামদানি:
মুঘল আমলে জামদানি শাড়ি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই শাড়িগুলি সুতির ওয়েভের উপর জটিল জরির কাজ করা হতো। ঢাকার জামদানি শাড়ি সেই সময়ে বিশেষভাবে বিখ্যাত ছিল।
পৈঠানি:
পৈঠানি বস্ত্রও মুঘল আমলে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। মহারাষ্ট্রের পৈঠান অঞ্চলে উৎপাদিত এই বস্ত্রগুলি রেশম ও জরির সংমিশ্রণে তৈরি হতো, যা তার সূক্ষ্মতা ও সৌন্দর্যের জন্য প্রসিদ্ধ।
উপসংহার:
মুঘল আমলে শিল্প ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে এক বিশাল বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। মুঘল স্থাপত্যের অসাধারণ নিদর্শনগুলি আজও সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে, যা ভারতীয় সংস্কৃতির এক অমূল্য সম্পদ। মুঘল চিত্রকলা ও বস্ত্রশিল্পের কীর্তিগুলিও সেই যুগের শৈল্পিক উৎকর্ষতার সাক্ষ্য বহন করে। এই সকল নিদর্শনগুলি মুঘল আমলের সৌন্দর্য, শৈল্পিকতা ও সমৃদ্ধির এক অমূল্য দৃষ্টান্ত হয়ে রয়ে গেছে।
***15) প্রশ্ন. মুঘল যুগের গ্রামীণ অর্থনীতি সংক্ষেপে আলোচনা কর। (৫ নম্বর)
ভূমিকা:
মুঘল যুগ ভারতীয় ইতিহাসের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সময়ে ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। মুঘল শাসনের সময়কালে গ্রামীণ অর্থনীতি ছিল দেশের মূল ভিত্তি। এই সময়ের কৃষি, কৃষি উৎপাদন, জমিদারি প্রথা, কৃষি কর ও অন্যান্য অর্থনৈতিক প্রথাগুলো গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম প্রধান উপাদান ছিল।
কৃষি ও কৃষি উৎপাদন:
মুঘল যুগের গ্রামীণ অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি ছিল কৃষি। মুঘল শাসকরা কৃষি উৎপাদনের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। ধান, গম, আখ, তুলা, সরিষা, বিভিন্ন শাকসবজি ও ফলমূল ছিল প্রধান ফসল। মুঘলরা সেচ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করে, যা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফসল উৎপাদনে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, যেমন সেচ খাল, কুয়ো ইত্যাদি মুঘলদের কৃষি ব্যবস্থার উন্নতির সাক্ষ্য বহন করে।
জমিদারি প্রথা:
মুঘল শাসনামলে জমিদারি প্রথা ছিল অত্যন্ত প্রচলিত। জমিদাররা গ্রামগুলোর প্রধান শাসক হিসেবে ভূমিকা পালন করতেন। তারা রাজস্ব সংগ্রহ করতেন এবং মুঘল শাসকদের কাছে জমির কর প্রদান করতেন। জমিদারদের মাধ্যমে কর সংগ্রহ প্রক্রিয়া ছিল বেশ দক্ষ এবং কার্যকরী, যা মুঘলদের রাজস্ব বৃদ্ধিতে সহায়ক ছিল।
রাজস্ব ব্যবস্থা:
মুঘলদের রাজস্ব ব্যবস্থা ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম প্রধান অংশ। আকবরের রাজত্বকালে তৈরিকৃত 'তোরেগোবিন্দ' বা 'দাহসরাহ' পদ্ধতি ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই পদ্ধতিতে জমির উৎপাদনশীলতা ও ফসলের ধরন অনুযায়ী কর নির্ধারণ করা হতো। ফসল উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ কর হিসেবে আদায় করা হতো, যা পরবর্তীতে 'আধিয়া' নামে পরিচিত হয়।
কৃষি কর:
মুঘল যুগে কৃষি কর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ধরনের করের মধ্যে 'জিজিয়া' ও 'খারাজ' ছিল প্রধান। জিজিয়া কর ছিল অমুসলিমদের উপর আরোপিত এবং খারাজ কর ছিল জমির উৎপাদন অনুযায়ী আদায় করা হতো। কর আদায়ের পদ্ধতি ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির একটি প্রধান উপাদান, যা রাজস্ব বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
বাণিজ্য ও কারিগরশিল্প:
মুঘল যুগে বাণিজ্য ও কারিগরশিল্পের উন্নতি হয়। গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের কারিগরশিল্পের প্রচলন ছিল। তাঁত, সুতার কাজ, মাটির পাত্র, ধাতব কাজ ইত্যাদি গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে সহায়ক ছিল। বাণিজ্যের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি প্রসারিত হয় এবং নগরকেন্দ্রিক অর্থনীতির সাথে সংযোগ স্থাপন হয়।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব:
মুঘল যুগে গ্রামীণ অর্থনীতি সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রভাব ফেলেছিল। কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয় এবং গ্রামীণ সমাজে স্থিতিশীলতা আসে। তবে, করের বোঝা ও জমিদারি শাসনের কারণে অনেক সময় কৃষকরা অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ত। তবুও, সামগ্রিকভাবে গ্রামীণ অর্থনীতি মুঘল শাসনের সময়ে একটি শক্তিশালী ভিত্তি লাভ করে।
উপসংহার:
মুঘল যুগের গ্রামীণ অর্থনীতি ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং সুসংগঠিত। কৃষি, জমিদারি প্রথা, কর ব্যবস্থা, বাণিজ্য ও কারিগরশিল্পের উন্নতির ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি মুঘল শাসনের সময়ে বিশেষ গুরুত্ব পায়। এই অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর নির্ভর করেই মুঘল শাসন তার শাসনব্যবস্থা ও সমাজে স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম হয়। গ্রামীণ অর্থনীতির এই উন্নয়ন মুঘল যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
***16) প্রশ্ন. মোঘল যুগের শহরের অর্থনীতির পরিচয় দাও। (৫ নম্বর)
মোঘল যুগের শহরের অর্থনীতির পরিচয়:
১. কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি:
মোঘল শহরের অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক ছিল। কৃষি থেকে উৎপন্ন পণ্যসমূহ যেমন ধান, গম, কাপাস, এবং অন্যান্য শস্য নগরের প্রধান অর্থনৈতিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করত। এই যুগে উন্নত সেচ ব্যবস্থা ও কৃষি প্রযুক্তির প্রয়োগ কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করেছিল। এছাড়াও, সম্রাট আকবরের 'দাহসালা' বা রাজস্ব ব্যবস্থা কৃষকদের থেকে সংগৃহীত কর নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ছিল, যা অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করত।
২. বাণিজ্য ও বাণিজ্য কেন্দ্র:
মোঘল যুগে বাণিজ্যিক কার্যকলাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দিল্লি, আগ্রা, লাহোর, এবং মুর্শিদাবাদের মতো শহরগুলি প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। মোঘল সম্রাটরা বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন নীতিমালা গ্রহণ করেছিল, যা বিদেশি বণিকদের আকৃষ্ট করেছিল। পারস্য, আরব, এবং ইউরোপীয় দেশগুলির সাথে ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। মসলিন, সিল্ক, কাশ্মীরি শাল, এবং মণি-মুক্তার মতো মূল্যবান পণ্যের রপ্তানি নগর অর্থনীতির অন্যতম প্রধান উৎস ছিল।
৩. শিল্প ও কারিগরি:
মোঘল শহরগুলির অর্থনীতিতে শিল্প ও কারিগরি পণ্যের উৎপাদন বিশেষ ভূমিকা পালন করত। মোঘল স্থাপত্যের নিদর্শন যেমন তাজমহল, লালকেল্লা ইত্যাদি শহরের কারিগরদের দক্ষতা ও নৈপুণ্যের সাক্ষ্য বহন করে। তাছাড়া, ধাতু শিল্প, বস্ত্র শিল্প, চামড়াশিল্প, এবং কাঁচ শিল্প শহরের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কারিগররা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেত এবং তাদের উৎপাদিত পণ্যসমূহ দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ও আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি হতো।
৪. মুদ্রা ও ব্যাংকিং:
মোঘল যুগে মুদ্রা ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা উন্নত ছিল। মোঘল সম্রাটরা নিজেদের নামে মুদ্রা প্রবর্তন করতেন এবং সেগুলি বাজারে প্রচলিত ছিল। আকবরের সময়ে প্রবর্তিত 'রুপি' মুদ্রা মোঘল সাম্রাজ্যের সর্বত্র ব্যবহৃত হতো। ব্যাংকিং ব্যবস্থার ক্ষেত্রে, 'সাহুকার' বা মহাজনরা নগদ অর্থ ধার দিত এবং ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিক লেনদেন সহজ করত। এছাড়া 'হুন্ডি' ব্যবস্থার প্রচলন ছিল, যা বর্তমানের চেক বা ড্রাফটের মতো কাজ করত।
৫. নগরায়ন ও নগর পরিকল্পনা:
মোঘল শহরগুলি সুপরিকল্পিত ও সুন্দরভাবে গঠিত ছিল। শহরগুলিতে প্রধান প্রধান সড়ক, বাজার, কারখানা, এবং আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছিল। মোঘল সম্রাটরা নগর পরিকল্পনায় বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। উদাহরণস্বরূপ, আকবরের স্থাপিত ফতেহপুর সিক্রি শহরটি অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ছিল। এছাড়া, মোঘল শহরগুলিতে উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল, যা বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে সহজতর করত।
৬. কর ও রাজস্ব ব্যবস্থা:
মোঘল শহরের অর্থনীতি রাজস্ব ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল ছিল। কৃষি, বাণিজ্য, এবং কারিগরি পণ্যের উপর নির্ধারিত হারে কর আরোপ করা হতো। সম্রাট আকবরের প্রবর্তিত 'দাহসালা' ব্যবস্থা রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল। এই ব্যবস্থায় জমির উর্বরতা ও উৎপাদনের ভিত্তিতে কর নির্ধারিত হতো, যা রাজস্ব আদায়কে কার্যকর ও সমতাভিত্তিক করেছিল।
উপসংহার:
মোঘল যুগের শহরের অর্থনীতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় ছিল। কৃষি, বাণিজ্য, শিল্প, মুদ্রা, এবং নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে মোঘল সম্রাটদের উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নগর অর্থনীতিকে স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ করেছিল। বর্তমান সময়ে মোঘল যুগের অর্থনৈতিক নীতি ও কর্মকাণ্ড ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। মোঘল শহরের অর্থনীতি শুধু তাদের সময়কেই নয়, পরবর্তী সময়ের অর্থনৈতিক কাঠামোতেও গভীর প্রভাব ফেলেছে।
Kalyani University BA 3rd Semester History Minor Long Question Answer SAQ Suggestion PDF টি পেতে.. আপনি ১১ টাকা পেমেন্ট করুন। পেমেন্টের পর এক সেকেন্ডের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সাজেশনটি পাবেন। টাকা টি পেমেন্ট করার জন্য নিচে PAY বাটনে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।