crossorigin="anonymous">     crossorigin="anonymous"> Kalyani University BA 1st Semester History Minor Long Question Answer 2024-2025

Kalyani University BA 1st Semester History Minor Long Question Answer 2024-2025

এখানে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সিলেবাস অনুযায়ী সাজানো আছে

University of Kalyani Suggestion

নিওলিথিক বা নব্য প্রস্তর যুগের সংস্কৃতি বা বিপ্লব:

এখানে অল্প কিছু প্রশ্নোত্তর আপলোড করা হয়েছে যদি তোমার মনে হয় সাজেশনটি BUY করতে পারো ।

History Minor Long Question Answer 2024-2025

History Minor -1

Course Code: HIST-MI-T-1

UNIT-1

****1) প্রশ্ন. নিওলিথিক বা নব্য প্রস্তর যুগের সংস্কৃতি বা বিপ্লব সম্পর্কে যা জান লেখ। (৫)

নিওলিথিক বা নব্য প্রস্তর যুগের সংস্কৃতি বা বিপ্লব:

নিওলিথিক যুগ, যা নব্য প্রস্তর যুগ নামেও পরিচিত, প্রাচীন প্রস্তর যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এই যুগে মানুষের জীবনধারা এবং সংস্কৃতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে, যা মানব সভ্যতার বিকাশের একটি প্রধান অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। এই যুগের বৈশিষ্ট্য এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিম্নে আলোচনা করা হল।

নিওলিথিক যুগের সময়কাল:

নিওলিথিক যুগ সাধারণত ১০,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। তবে বিভিন্ন অঞ্চলে এর সময়কাল কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। এই যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল কৃষি এবং গৃহপালিত প্রাণীর পালন শুরু হওয়া, যা মানুষের জীবনযাত্রায় মৌলিক পরিবর্তন এনে দেয়।

কৃষি এবং গৃহপালিত প্রাণীর পালন:

নিওলিথিক যুগে মানুষের প্রধান অর্জন ছিল কৃষির সূচনা। এই সময়ে মানুষ ধান, গম, যব এবং অন্যান্য শস্যের চাষ শুরু করে। কৃষির উদ্ভাবন মানুষের জীবনধারায় স্থায়িত্ব এনে দেয় এবং তাদের যাযাবর জীবন থেকে স্থায়ী বসবাসের দিকে নিয়ে যায়। এই সময়ে গৃহপালিত প্রাণীর পালনও শুরু হয়, যেমন গরু, ছাগল, ভেড়া এবং কুকুর।

স্থায়ী বসতি এবং গ্রামের সৃষ্টি:

কৃষির ফলে মানুষ স্থায়ী বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। তারা মাটির ঘর, পাথরের ঘর এবং অন্যান্য স্থায়ী আবাস নির্মাণ করে। এভাবে গ্রামের সৃষ্টি হয় এবং সমাজবদ্ধ জীবন শুরু হয়। গ্রামগুলি প্রায়ই নদীর তীরে গড়ে উঠত, কারণ জল সরবরাহ এবং উর্বর জমির প্রয়োজন ছিল। স্থায়ী বসতি স্থাপনের ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং সামাজিক কাঠামো আরও জটিল হয়।

কারুশিল্প এবং প্রযুক্তির উন্নতি:

নিওলিথিক যুগে কারুশিল্প এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটে। মানুষ পাথর, মাটি এবং হাড় দিয়ে বিভিন্ন প্রকারের সরঞ্জাম এবং অস্ত্র তৈরি করতে শুরু করে। তারা মৃৎশিল্পের বিকাশ ঘটায়, যা খাদ্য সংরক্ষণ এবং রান্নার জন্য ব্যবহৃত হত। এছাড়া তাঁত বুনন এবং বস্ত্র উৎপাদনও এই সময়ে শুরু হয়।

ধর্ম এবং সংস্কৃতি:

নিওলিথিক যুগে ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। মানুষ প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানকে পূজা করতে শুরু করে এবং তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সেগুলিকে সম্মান জানাত। এই সময়ে পাথরের মূর্তি, মন্দির এবং ধর্মীয় স্থান তৈরি হয়। পূর্বপুরুষদের পূজা এবং তাদের স্মরণে বিশেষ আচার-অনুষ্ঠানের প্রচলনও দেখা যায়।

সাংস্কৃতিক বিপ্লব:

নিওলিথিক যুগকে প্রায়ই সাংস্কৃতিক বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করা হয়, কারণ এই সময়ে মানুষের জীবনধারায় মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। কৃষির উদ্ভাবন, স্থায়ী বসতি স্থাপন, কারুশিল্পের বিকাশ এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিবর্তনগুলি মানুষের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোকে পুনর্গঠিত করে। এই বিপ্লব মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে এবং সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

নিওলিথিক যুগের উদাহরণ:

নিওলিথিক যুগের বিভিন্ন স্থাপনা এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আমাদেরকে এই যুগের সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দেয়। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নিওলিথিক স্থাপনা পাওয়া গেছে, যেমন তুরস্কের চাতাল হোয়ুক, ইংল্যান্ডের স্টোনহেঞ্জ, এবং ভারতের মেহরগড়। এসব স্থানে পাওয়া নিদর্শনগুলি নিওলিথিক মানুষের জীবনধারা, শিল্পকলা এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটায়।

উপসংহার:

নিওলিথিক বা নব্য প্রস্তর যুগ মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই সময়ে মানুষের জীবনধারা এবং সংস্কৃতিতে যে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে, তা পরবর্তী সভ্যতাগুলির ভিত্তি স্থাপন করে। কৃষি, স্থায়ী বসতি, কারুশিল্প এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের বিকাশ মানুষের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোকে নতুনভাবে গড়ে তোলে। নিওলিথিক যুগের সংস্কৃতি এবং বিপ্লব মানব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিরস্থায়ী স্থান পেয়েছে।

****2) প্রশ্ন. হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতার প্রধান নাগরিক বৈশিষ্ট্য গুলি লেখ। ১০

হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতার প্রধান নাগরিক বৈশিষ্ট্য:

হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতা প্রাচীন ভারতের অন্যতম বিখ্যাত এবং উন্নত সভ্যতা হিসেবে পরিচিত। এটি ছিল একটি প্রাচীন নগরসভ্যতা যা খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২৬০০ থেকে ১৯০০ বছর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই সভ্যতার উন্নত নগর পরিকল্পনা, স্থাপত্য ও সংস্কৃতি আজও আমাদেরকে মুগ্ধ করে। এখানে আমরা হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতার প্রধান নাগরিক বৈশিষ্ট্যগুলি বিশদে আলোচনা করব।

১. উন্নত নগর পরিকল্পনা:

হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এর সুসংবদ্ধ এবং পরিকল্পিত নগর ব্যবস্থা। নগরগুলো সাধারণত একটি গ্রিড পদ্ধতিতে নির্মিত হত, যেখানে সোজা রাস্তা এবং নিয়মিত ব্লক থাকত। নগরগুলির রাস্তা ছিল প্রশস্ত এবং সোজা, যা নগরের পরিবহন এবং যোগাযোগকে সহজ করত। রাস্তাগুলির পাশে ড্রেনেজ ব্যবস্থা ছিল যা বৃষ্টির পানি বা অন্যান্য বর্জ্য অপসারণে সহায়ক ছিল।

২. উন্নত স্থাপত্য এবং ইমারত:

সিন্ধু সভ্যতার মানুষেরা ইমারত নির্মাণে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করত। তারা পোড়া ইট, কাঁদা এবং কাঠ ব্যবহার করে ইমারত নির্মাণ করত। নগরগুলিতে বড় বড় বাড়ি, প্রশাসনিক ভবন, মন্দির, এবং গোদামঘর পাওয়া গেছে। বড় বড় গোদামঘরগুলিতে শস্য সংরক্ষণ করা হত, যা তাদের কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।

৩. ড্রেনেজ এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা:

হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল এর উন্নত ড্রেনেজ এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। প্রতিটি বাড়িতে একটি নির্দিষ্ট ড্রেনেজ ব্যবস্থা ছিল যা প্রধান ড্রেনেজ লাইনে সংযুক্ত ছিল। এই প্রধান ড্রেনগুলি নগরীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হত এবং শহরের বাইরে বর্জ্য পানি নিষ্কাশন করত। এই ব্যবস্থা নগরের স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।

৪. জলের ব্যবস্থাপনা:

হরপ্পা সভ্যতায় জলের ব্যবস্থাপনা ছিল অত্যন্ত উন্নত। নগরের বিভিন্ন স্থানে কূপ এবং জলাশয় পাওয়া গেছে, যা নগরের মানুষের পানীয় জল সরবরাহের জন্য ব্যবহার হত। এছাড়াও, কিছু নগরে বড় বড় জলাধার বা রিজার্ভার পাওয়া গেছে, যা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং শুষ্ক মৌসুমে জল সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত হত।

৫. সমৃদ্ধ অর্থনীতি:

হরপ্পা সভ্যতার অর্থনীতি ছিল সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময়। কৃষি ছিল তাদের প্রধান পেশা, যেখানে তারা গম, যব, মসুর, সরষে ইত্যাদি শস্য উৎপাদন করত। এছাড়াও, তারা পশুপালন এবং মৎস্য শিকার করত। হরপ্পার মানুষেরা কারুশিল্পেও পারদর্শী ছিল। তারা পাথর, ধাতু, মাটি এবং কাঁচের জিনিসপত্র তৈরি করত। এই সভ্যতার মানুষেরা ব্যবসা-বাণিজ্যেও জড়িত ছিল এবং তারা মেসোপটেমিয়া, পারস্য উপত্যকা এবং মধ্য এশিয়ার সাথে বাণিজ্য করত।

৬. ধর্ম এবং সংস্কৃতি:

হরপ্পা সভ্যতার মানুষেরা ধর্ম এবং সংস্কৃতিতে উন্নত ছিল। তারা বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করত এবং বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করত। হরপ্পার মুদ্রা এবং সীলমোহরগুলিতে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতীক এবং দেবদেবীর চিত্র পাওয়া গেছে, যা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিচয় বহন করে। এছাড়াও, হরপ্পার মানুষেরা বিভিন্ন ধরনের শিল্পকলা এবং সংগীতের চর্চা করত।

৭. লেখনী এবং ভাষা:

হরপ্পা সভ্যতার মানুষরা একটি নিজস্ব লিপি বা লেখনী ব্যবহার করত, যা এখনও পুরোপুরি পাঠোদ্ধার করা যায়নি। এই লিপির মাধ্যমে তারা বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজকর্ম এবং বাণিজ্যিক লেনদেন পরিচালনা করত। এই লিপির ব্যবহার তাদের উন্নত সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় বহন করে।

৮. সামাজিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা:

হরপ্পা সভ্যতায় একটি সুসংগঠিত সামাজিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল। সমাজটি মূলত চারটি স্তরে বিভক্ত ছিল - রাজা বা শাসক, পুরোহিত বা ধর্মীয় নেতা, ব্যবসায়ী বা কারুশিল্পী, এবং কৃষক বা শ্রমিক। শাসকরা নগর পরিচালনা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করত, পুরোহিতরা ধর্মীয় কাজকর্ম পরিচালনা করত, ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য এবং কারুশিল্পের কাজ করত এবং কৃষকরা কৃষিকাজ করত। এই ব্যবস্থা সমাজে শৃঙ্খলা এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখত।

৯. বাণিজ্য এবং যোগাযোগ:

হরপ্পা সভ্যতার মানুষেরা দূরবর্তী স্থানের সাথে বাণিজ্য এবং যোগাযোগ রক্ষা করত। তারা স্থলপথ এবং জলপথে বাণিজ্য করত এবং বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করত। হরপ্পার মুদ্রা, সীলমোহর এবং বিভিন্ন ধরনের পণ্য পাওয়া গেছে যা মেসোপটেমিয়া এবং পারস্য উপত্যকার সাথে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্কের প্রমাণ দেয়। এছাড়াও, তারা সমুদ্রপথে বিভিন্ন দেশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করত এবং এই পথে তারা বিভিন্ন ধরনের জ্ঞান এবং সংস্কৃতি বিনিময় করত।

১০. প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান:

হরপ্পা সভ্যতার মানুষেরা প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানে উন্নত ছিল। তারা কৃষিকাজে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করত এবং সেচব্যবস্থা উন্নত করেছিল। এছাড়াও, তারা ধাতুবিদ্যায় পারদর্শী ছিল এবং তামা, ব্রোঞ্জ, সোনা এবং রুপার ব্যবহার করত। হরপ্পার মানুষেরা চিকিৎসা বিজ্ঞানেও পারদর্শী ছিল এবং তারা বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে প্রাকৃতিক ঔষধ ব্যবহার করত।

উপসংহার:

হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতা ছিল প্রাচীন ভারতের অন্যতম উন্নত এবং সমৃদ্ধ সভ্যতা। তাদের উন্নত নগর পরিকল্পনা, স্থাপত্য, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, জল ব্যবস্থাপনা, সমৃদ্ধ অর্থনীতি, ধর্ম এবং সংস্কৃতি, লেখনী, সামাজিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা, বাণিজ্য এবং যোগাযোগ, এবং প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের উন্নয়ন আমাদেরকে মুগ্ধ করে। এই সভ্যতা আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ এবং এটি আমাদেরকে আমাদের পূর্বপুরুষদের মহান কীর্তির কথা মনে করিয়ে দেয়।

Kalyani University BA 1st Semester History Minor Long Question Answer

*****3) প্রশ্ন. বৈদিক যুগের শতকে ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিচয় দাও। ৫+৫

বৈদিক যুগ (১৫০০-৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সময়কালটি প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত: প্রাথমিক বৈদিক যুগ এবং পরবর্তী বৈদিক যুগ। এই যুগের সময় ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুমুখী। নিচে এই যুগের আর্থ-সামাজিক অবস্থার একটি বিশদ বিবরণ দেওয়া হলো।

আর্থিক অবস্থা:

১. কৃষি: বৈদিক যুগের প্রধান অর্থনৈতিক কার্যক্রম ছিল কৃষি। আর্যরা নদীর তীরে স্থায়ী বসতি স্থাপন করে কৃষিকাজ শুরু করে। তাঁরা গম, যব, বাজরা, ধান ইত্যাদি ফসল উৎপাদন করত। কৃষিকাজের জন্য গরু ও বলদ ব্যবহৃত হতো।

২. গৃহপালিত পশু: গবাদি পশু পালন বৈদিক সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। গরু ছিল সম্পদের প্রতীক এবং অর্থনৈতিক স্থিতির মাপকাঠি। গরুর দুধ, গোবর, এবং চামড়া বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হতো।

৩. বিনিময় ব্যবস্থা: বৈদিক যুগে মুদ্রার প্রচলন না থাকায় বিনিময় ব্যবস্থার মাধ্যমে পণ্য ও সেবা আদান-প্রদান করা হতো। গবাদি পশু বিনিময়ের একটি সাধারণ মাধ্যম ছিল।

৪. কারুশিল্প ও বাণিজ্য: বৈদিক সমাজে বিভিন্ন কারুশিল্পের প্রচলন ছিল। তাঁতিরা কাপড় বুনত, লোহার কাজ এবং ধাতব কাজও প্রচলিত ছিল। এ সময়ে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যও উন্নত ছিল। তাঁরা গবাদি পশু, শস্য এবং অন্যান্য সামগ্রী বিনিময় করত।

৫. যুদ্ধ ও লুণ্ঠন: যুদ্ধও আর্থিক অবস্থার উপর প্রভাব ফেলত। বিজিত রাজ্য থেকে লুণ্ঠিত সম্পদ এবং গবাদি পশু অর্থনীতির একটি অংশ হয়ে উঠত।

সামাজিক অবস্থা:

১. বর্ণ ব্যবস্থা: বৈদিক যুগে সমাজ চারটি প্রধান বর্ণে বিভক্ত ছিল: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, এবং শূদ্র। ব্রাহ্মণরা ছিলেন পুরোহিত এবং জ্ঞানী, ক্ষত্রিয়রা ছিলেন যোদ্ধা এবং শাসক, বৈশ্যরা ছিলেন বণিক এবং কৃষক, এবং শূদ্ররা ছিলেন শ্রমিক এবং সেবক।

২. পরিবার ব্যবস্থা: বৈদিক যুগে পরিবার ছিল পিতৃতান্ত্রিক। পরিবারে পিতা প্রধান কর্তৃপক্ষ ছিলেন এবং সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। যৌথ পরিবার ব্যবস্থাও প্রচলিত ছিল।

৩. নারীর অবস্থান: বৈদিক যুগের প্রাথমিক পর্যায়ে নারীরা সম্মানিত ছিলেন এবং তাঁদের শিক্ষা গ্রহণের অধিকার ছিল। কিন্তু পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীদের অবস্থার অবনতি ঘটে। তাঁদের অধিকাংশ গৃহকর্মে সীমাবদ্ধ রাখা হতো।

৪. শিক্ষা: শিক্ষা গুরু-শিষ্য পরম্পরায় গুরুকুলে প্রদান করা হতো। বৈদিক সাহিত্য, ধর্মগ্রন্থ, এবং যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ব্রাহ্মণদের মধ্যে শিক্ষার বিশেষ গুরুত্ব ছিল।

৫. ধর্ম ও আচার-অনুষ্ঠান: বৈদিক যুগে আর্যরা প্রকৃতি পূজায় বিশ্বাস করত। তাঁরা বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করত, যেমন ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ, সোম ইত্যাদি। যজ্ঞ এবং হোম ছিল ধর্মীয় অনুষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

৬. বিনোদন ও সংস্কৃতি: বৈদিক যুগে সংগীত, নৃত্য, এবং খেলাধুলার প্রচলন ছিল। বিভিন্ন ধরনের খেলা, যেমন দৌড়, মল্লযুদ্ধ, এবং রথযুদ্ধ, বিনোদনের অংশ ছিল। গায়ক এবং নর্তকীরা রাজা এবং প্রজাদের বিনোদন দিতেন।

৭. খাদ্য ও পোশাক: বৈদিক যুগে মানুষ প্রধানত শস্য, ফলমূল, দুধ এবং মাংস খেত। পোশাক হিসেবে তাঁরা লুঙ্গি এবং ওড়না ব্যবহার করত। গহনা এবং অলঙ্কার পরিধান করাও সাধারণ ছিল।

উপসংহার:

বৈদিক যুগে ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ছিল বহুমুখী এবং উন্নত। কৃষি, গবাদি পশু পালন, কারুশিল্প, এবং বাণিজ্যের মাধ্যমে আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে বর্ণ ব্যবস্থা, পরিবার ব্যবস্থা, এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বিশেষ গুরুত্ব পেত। এই যুগের আর্থ-সামাজিক অবস্থা প্রাচীন ভারতের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতিফলন।

এই আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় যে বৈদিক যুগে ভারতের সমাজ ও অর্থনীতি ছিল একটি সুসংহত এবং সমৃদ্ধ কাঠামো। বৈদিক সাহিত্য এবং ধর্মগ্রন্থগুলি এই সময়ের আর্থ-সামাজিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে, যা আমাদের প্রাচীন ভারতের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বুঝতে সাহায্য করে।

****4) প্রশ্ন. মগধ সাম্রাজ্য উত্থানের পিছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলি আলোচনা কর। ১০

মগধ সাম্রাজ্য ভারতের প্রাচীন ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই সাম্রাজ্যের উত্থান বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। এই রচনায় আমরা মগধ সাম্রাজ্যের উত্থানের পিছনে থাকা প্রধান কারণগুলি বিশ্লেষণ করব।

রাজনৈতিক কারণ:

১. শক্তিশালী নেতৃত্ব: মগধ সাম্রাজ্যের উত্থানের পিছনে একটি প্রধান কারণ ছিল দক্ষ ও শক্তিশালী নেতৃত্ব। রাজা বিম্বিসার এবং অজাতশত্রু মগধের প্রথম দিকের শাসকগণ ছিলেন যারা মগধের রাজনৈতিক শক্তি ও সাম্রাজ্য বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিম্বিসার তার সাম্রাজ্যকে সংগঠিত ও সুদৃঢ় করেছিলেন এবং অজাতশত্রু বিভিন্ন যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন।

২. কৌশলগত বিবাহ:
বিম্বিসার তার সাম্রাজ্যের সুরক্ষা ও বিস্তারের জন্য কৌশলগত বিবাহের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি কোশল, লিচ্ছবি এবং মল্লের মতো প্রতিবেশী রাজ্যগুলির রাজকুমারীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সাম্রাজ্যের সীমানা ও শক্তি বৃদ্ধি করেছিলেন। এই বিবাহগুলি মগধের সাথে অন্যান্য রাজ্যের মৈত্রী ও রাজনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করেছিল।

৩. বিস্তৃত সামরিক শক্তি:
মগধ সাম্রাজ্যের শাসকগণ তাদের সামরিক শক্তিকে সম্প্রসারিত ও সুসংগঠিত করেছিলেন। শক্তিশালী ও সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী গঠনের মাধ্যমে তারা প্রতিবেশী রাজ্যগুলির বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছিলেন। যুদ্ধের জন্য উন্নত অস্ত্র ও কৌশল ব্যবহার করেছিলেন, যা মগধকে সামরিক দিক থেকে সুদৃঢ় করেছিল।

অর্থনৈতিক কারণগুলি:

১. উর্বর ভূমি ও কৃষি উৎপাদন: মগধ অঞ্চলের উর্বর ভূমি ও উপযুক্ত জলবায়ুর কারণে কৃষি উৎপাদন ছিল অত্যন্ত উচ্চমানের। গঙ্গা ও সোন নদীর অববাহিকায় অবস্থিত হওয়ার কারণে এই অঞ্চলে কৃষি চাষাবাদ ও শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল। ধান, গম, যব, এবং অন্যান্য খাদ্যশস্যের উৎপাদন মগধের অর্থনীতিকে মজবুত করেছিল।

২. বাণিজ্য ও বাণিজ্য পথ: মগধ সাম্রাজ্য বাণিজ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। এটি ভারতের বিভিন্ন বাণিজ্য পথের সংযোগস্থলে অবস্থিত ছিল, যা দেশীয় ও আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যের জন্য সুবিধাজনক ছিল। গঙ্গা নদীর পথ বাণিজ্যিক যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল, যা সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছিল।

৩. ধাতু সম্পদ ও কারিগরি শিল্প: মগধ অঞ্চলে লোহা, তামা এবং অন্যান্য ধাতুর সম্পদ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। এই ধাতুগুলি থেকে উন্নত অস্ত্র ও সরঞ্জাম তৈরি করে মগধের কারিগরি শিল্প উন্নত হয়েছিল। লোহা ও তামার খনি থেকে প্রাপ্ত সম্পদ সাম্রাজ্যের অর্থনীতিকে মজবুত করেছিল।

৪. শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য ও নগরায়ণ: মগধের শাসকগণ স্থাপত্য ও নগরায়ণের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। উন্নত নগর পরিকল্পনা ও বিশাল স্থাপত্য নির্মাণ করে তারা মগধের সৌন্দর্য ও গৌরব বৃদ্ধি করেছিলেন। রাস্তাঘাট, সেচ ব্যবস্থা, ও বন্দর নির্মাণ করে তারা বাণিজ্য ও কৃষি কার্যক্রমকে সহজতর করেছিলেন।

সমাপ্তি:

মগধ সাম্রাজ্যের উত্থান বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণের ফলস্বরূপ হয়েছে। শক্তিশালী নেতৃত্ব, কৌশলগত বিবাহ, ও বিস্তৃত সামরিক শক্তি মগধের রাজনৈতিক শক্তিকে বৃদ্ধি করেছিল। অন্যদিকে, উর্বর ভূমি, উন্নত কৃষি, বাণিজ্যিক সুবিধা, ধাতু সম্পদ, ও উন্নত স্থাপত্য মগধের অর্থনৈতিক শক্তিকে সুদৃঢ় করেছিল। এই সমস্ত কারণগুলি মগধ সাম্রাজ্যের উত্থানের পিছনে মূল ভূমিকা পালন করেছিল, যা ভারতের ইতিহাসে একটি গৌরবময় অধ্যায় হয়ে আছে।

****5) প্রশ্ন. পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীদের মর্যাদা কি হ্রাস পেয়েছিল আলোচনা কর। ৫

ভূমিকা: ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে বৈদিক যুগ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বৈদিক যুগ সাধারণত দুটি পর্যায়ে বিভক্ত – প্রারম্ভিক বৈদিক যুগ এবং পরবর্তী বৈদিক যুগ। নারীদের মর্যাদা নিয়ে বৈদিক যুগের প্রাথমিক পর্যায়ের তুলনায় পরবর্তী বৈদিক যুগে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

প্রারম্ভিক বৈদিক যুগে নারীদের মর্যাদা: প্রারম্ভিক বৈদিক যুগে নারীরা ছিলেন সমাজের অন্যতম সম্মানিত সদস্য। নারীরা শিক্ষার অধিকার লাভ করতেন এবং তাদেরকে বিভিন্ন ধর্মীয় এবং সামাজিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ করতে দেখা যেত। এমনকি তারা বেদ পাঠ ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দিতেন। নারীদের এই সমৃদ্ধ মর্যাদা প্রমাণ করে যে সমাজে তাদের অবস্থান যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীদের মর্যাদা:
পরবর্তী বৈদিক যুগে সমাজে কিছু পরিবর্তন আসে, যা নারীদের মর্যাদার উপর প্রভাব ফেলে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা এই সময়ে নারীদের মর্যাদার হ্রাস প্রমাণ করে তা নিচে আলোচনা করা হলো:

১. শিক্ষার অধিকার হ্রাস: পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীদের শিক্ষার অধিকার সীমিত হয়ে পড়ে। তারা ধীরে ধীরে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে থাকেন এবং তাদের শিক্ষার সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসে। শিক্ষার অভাবে তারা সমাজে পূর্বের মতো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হননি।

২. বিবাহের উপর নিয়ন্ত্রণ: পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীদের বিবাহের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়। পূর্বে যেখানে তারা নিজের পছন্দমতো বিবাহ করতে পারতেন, এই যুগে তাদেরকে পিতামাতার ইচ্ছার উপর নির্ভর করতে হয়। এছাড়া, বাল্যবিবাহের প্রচলনও দেখা যায়, যা নারীদের স্বাধীনতাকে আরো সংকুচিত করে দেয়।

৩. ধর্মীয় এবং সামাজিক অধিকার হ্রাস: নারীরা ধর্মীয় এবং সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হতে থাকেন। তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ কমে যায় এবং তাদের ভূমিকা শুধুমাত্র গৃহস্থালির কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

৪. সম্পত্তির অধিকার: পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীরা সম্পত্তির অধিকার হারান। পূর্বে তারা পিতার সম্পত্তিতে অধিকার পেতেন এবং বিবাহের পর স্বামীর সম্পত্তিতে অংশীদার হতে পারতেন। কিন্তু এই যুগে নারীদের সম্পত্তির অধিকার সীমিত হয়ে পড়ে এবং তারা সম্পূর্ণরূপে পুরুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।

৫. বহুবিবাহ ও পুত্র সন্তানের প্রতি গুরুত্ব: এই যুগে বহুবিবাহের প্রচলন বৃদ্ধি পায় এবং পুত্র সন্তানের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপিত হয়। নারীরা শুধুমাত্র পুত্র সন্তানের জন্মদানের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হতে থাকেন এবং তাদের মর্যাদা এর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

৬. বিধবা নারীদের অবস্থা: পরবর্তী বৈদিক যুগে বিধবা নারীদের অবস্থাও খুব শোচনীয় হয়ে পড়ে। তাদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো এবং তারা নানাভাবে অত্যাচারিত হতেন। বিধবাদের পুনরায় বিবাহের সুযোগ থাকত না, যা তাদের জীবনকে আরো কঠিন করে তোলে।

উপসংহার:

পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীদের মর্যাদা প্রারম্ভিক বৈদিক যুগের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছিল। শিক্ষার অভাব, সম্পত্তির অধিকার হ্রাস, ধর্মীয় এবং সামাজিক অধিকার সীমাবদ্ধতা, বিবাহের উপর নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে নারীদের মর্যাদা এবং স্বাধীনতা হ্রাস পায়। তবে, এ সময়ের কিছু নারীর জীবনেও সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে উচ্চ মর্যাদা লাভের উদাহরণ পাওয়া যায়, যা এই যুগের নারীদের সংগ্রামী চরিত্রের প্রমাণ। নারীদের মর্যাদা পুনরুদ্ধার ও উন্নতির জন্য ভবিষ্যতে অনেক পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল।

UNIT-2

****6) প্রশ্ন.মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের প্রধান কারণ গুলি আলোচনা কর। ৫/১০

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের প্রধান কারণ:

মৌর্য সাম্রাজ্য ছিল ভারতের প্রাচীনকালের অন্যতম বৃহত্তম এবং শক্তিশালী সাম্রাজ্য। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবং তার বংশধররা এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলো বহুবিধ এবং বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। এখানে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের প্রধান কারণগুলি নিয়ে আলোচনা করা হলো:

১. প্রশাসনিক দুর্বলতা:

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল প্রশাসনিক দুর্বলতা। অশোকের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়তে শুরু করে। কেন্দ্রীয় প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং প্রাদেশিক শাসকরা স্বাধীন হয়ে ওঠে। তারা কেন্দ্রীয় শাসনের প্রতি আনুগত্য হারায় এবং নিজেদের ক্ষমতা বাড়াতে চেষ্টা করে।

২. আর্থিক সংকট:

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের আরেকটি প্রধান কারণ ছিল আর্থিক সংকট। অশোকের সময় সাম্রাজ্যের ব্যাপক সামরিক খরচ এবং বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়। এর ফলে রাজকোষ শূন্য হয়ে পড়ে এবং সাম্রাজ্যের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটে। এর ফলে সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব দেখা দেয়।

৩. সামরিক দুর্বলতা:

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের আরেকটি প্রধান কারণ ছিল সামরিক দুর্বলতা। অশোকের পরবর্তী শাসকরা সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তি ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। সীমান্ত এলাকায় আক্রমণ ও বিদ্রোহ বাড়তে থাকে এবং সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী সেগুলি মোকাবিলা করতে সক্ষম হয় না। এর ফলে সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে।

৪. প্রাদেশিক বিদ্রোহ:

অশোকের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশে বিদ্রোহ শুরু হয়। প্রাদেশিক শাসকরা কেন্দ্রীয় শাসনের প্রতি আনুগত্য হারিয়ে ফেলে এবং নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে। এর ফলে সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয় এবং সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে।

৫. নেতৃত্বের অভাব:

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ ছিল যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। অশোকের পরবর্তী শাসকরা তার মতো দক্ষ ও শক্তিশালী নেতা হতে পারেননি। তাদের মধ্যে অনেকেই দুর্বল এবং অদক্ষ ছিলেন। এর ফলে সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ও সামরিক ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে পড়ে।

৬. বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার:

অশোকের সময় বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটে। অশোক নিজেই বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে এবং সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। এর ফলে সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটে এবং সামরিক শক্তি হ্রাস পায়। এছাড়া, বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসা নীতি সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তিকে দুর্বল করে তোলে।

৭. প্রাকৃতিক দুর্যোগ:

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের আরেকটি কারণ ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। খরা, বন্যা, মহামারি ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলিও সাম্রাজ্যের অর্থনীতি ও সমাজের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলে কৃষি উৎপাদন কমে যায় এবং সাম্রাজ্যের খাদ্য সংকট দেখা দেয়।

৮. বহিরাগত আক্রমণ:

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের আরেকটি প্রধান কারণ ছিল বহিরাগত আক্রমণ। শক, হুন, পার্থিয়ান ইত্যাদি বহিরাগত আক্রমণকারীরা সাম্রাজ্যের সীমান্ত এলাকায় হামলা চালায় এবং সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করে। এর ফলে সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে এবং সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে।

৯. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন:

মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়কালে সমাজ ও সংস্কৃতিতে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার, বৈদিক ধর্মের প্রভাব হ্রাস, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ইত্যাদি পরিবর্তনগুলি সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে। এর ফলে সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।

১০. অভ্যন্তরীণ কলহ:

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের আরেকটি কারণ ছিল অভ্যন্তরীণ কলহ। রাজপরিবারের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই, প্রাদেশিক শাসকদের মধ্যে বিরোধ, সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে বিদ্রোহ ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ কলহগুলি সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে এবং সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়।

উপসংহার:

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি বহুবিধ এবং পরস্পর সম্পর্কিত। প্রশাসনিক দুর্বলতা, আর্থিক সংকট, সামরিক দুর্বলতা, প্রাদেশিক বিদ্রোহ, নেতৃত্বের অভাব, বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বহিরাগত আক্রমণ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এবং অভ্যন্তরীণ কলহ - এই সমস্ত কারণগুলি মিলিতভাবে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়। এ থেকে বোঝা যায় যে, একটি সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ও স্থিতিশীলতা নির্ভর করে বিভিন্ন উপাদানের উপর এবং সেগুলির সুষ্ঠু সমন্বয় ও পরিচালনার উপর।

****7) প্রশ্ন. মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য অশোক কি দায়ী ছিল? ৫

মৌর্য সাম্রাজ্যের ইতিহাসে অশোক অন্যতম প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ শাসক ছিলেন। তার শাসনকালের সময় সাম্রাজ্য তার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটে। তবে অশোকের শাসনকালই সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। এখানে অশোকের দায়িত্বের বিষয়গুলি বিশ্লেষণ করা হলো:

১. বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ও অহিংস নীতি:

অশোকের সময় বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে এবং তিনি অহিংসার নীতি গ্রহণ করেন। তিনি যুদ্ধবিগ্রহ থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেন, যা সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তিকে দুর্বল করে তোলে। এছাড়া, বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন, যা সাম্রাজ্যের আর্থিক অবস্থাকে দুর্বল করে দেয়।

২. অর্থনৈতিক দুর্বলতা:

অশোকের শাসনামলে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার ও সেবা কর্মের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়। এর ফলে সাম্রাজ্যের রাজকোষ শূন্য হতে শুরু করে এবং অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। এর ফলে সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ও সামরিক কার্যক্রমে আর্থিক সংকট দেখা দেয়।

৩. প্রশাসনিক পরিবর্তন:

অশোক তার শাসনামলে প্রশাসনিক কাঠামোতে বিভিন্ন পরিবর্তন আনেন। তিনি প্রাদেশিক শাসকদের উপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেন এবং বিভিন্ন প্রদেশে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য সুশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এর ফলে প্রাদেশিক শাসকরা নিজেদের স্বাধীনভাবে পরিচালনা করতে শুরু করেন, যা সাম্রাজ্যের এককতা ও স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলে।

৪. উত্তরাধিকার সংকট:

অশোকের পর তার উত্তরাধিকারীরা দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাব দেখান। অশোকের পরবর্তী শাসকরা তার মতো শক্তিশালী ও দক্ষ ছিলেন না। এর ফলে সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ও সামরিক ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং প্রাদেশিক বিদ্রোহ ও বহিরাগত আক্রমণ বাড়তে থাকে।

৫. অশোকের আত্মবিশ্বাস ও প্রচারমুখিতা:

অশোক তার শাসনামলে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী ও প্রচারমুখী ছিলেন। তিনি নিজেকে 'ধর্মাশোক' বা 'ধর্মপ্রিয় অশোক' হিসেবে পরিচিত করতে চেয়েছিলেন এবং এর জন্য তিনি প্রচুর অর্থ ও সম্পদ ব্যয় করেন। এর ফলে সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ও সামরিক স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

উপসংহার:

অশোকের শাসনকালের সময় মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের মূল কারণগুলির মধ্যে তার বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার, অহিংসার নীতি, প্রশাসনিক পরিবর্তন, অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং উত্তরাধিকার সংকট উল্লেখযোগ্য। যদিও অশোক একজন মহান শাসক ও সমাজ সংস্কারক ছিলেন, তার শাসনকালের কিছু নীতি ও সিদ্ধান্ত সাম্রাজ্যের দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্বে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। তবে এককভাবে অশোককে সম্পূর্ণ দায়ী করা সঠিক নয়; বরং সাম্রাজ্যের পতনের পেছনে বহুবিধ কারণ কাজ করেছে, যা অশোকের শাসনের পরবর্তী সময়ে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

*****8) প্রশ্ন. মৌর্য সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রশাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর। ১০

মৌর্য সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রশাসন ব্যবস্থা:

মৌর্য সাম্রাজ্য (৩২২-১৮৫ খ্রিস্টপূর্ব) প্রাচীন ভারতের অন্যতম বৃহত্তম ও সুসংগঠিত সাম্রাজ্য ছিল। এটি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরে তার পুত্র বিন্দুসার এবং নাতি অশোক মৌর্যের অধীনে শীর্ষে পৌঁছায়। মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রশাসন ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সংগঠিত ও কাঠামোবদ্ধ, যা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক স্তরে বিভক্ত ছিল।

কেন্দ্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থা:

মৌর্য সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় প্রশাসন ছিল মূলত রাজা বা সম্রাটের হাতে কেন্দ্রীভূত। রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর এবং সমস্ত প্রশাসনিক কার্যক্রম তার অধীনে পরিচালিত হতো।

1. রাজা: মৌর্য সম্রাট ছিলেন সাম্রাজ্যের সর্বময় কর্তা। তিনি সমস্ত প্রশাসনিক, বিচারিক, সামরিক ও ধর্মীয় কার্যক্রমের উপর নজরদারি করতেন।

2. মন্ত্রী পরিষদ: রাজাকে সহায়তা করার জন্য একটি মন্ত্রী পরিষদ ছিল, যাকে 'মন্ত্রিসভা' বলা হতো। এই পরিষদের প্রধান ছিলেন 'মহামাত্র'। মন্ত্রীরা বিভিন্ন বিভাগীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতেন, যেমন অর্থনীতি, যুদ্ধ, আইন, এবং জনকল্যাণ।

3. ধর্ম মহামাত্র: অশোকের সময় 'ধর্ম মহামাত্র' নামে একটি নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়। এরা নৈতিকতা ও ধর্মীয় কার্যক্রমের তত্ত্বাবধান করতেন এবং বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য দায়িত্বশীল ছিলেন।

4. অমাত্য: 'অমাত্য' পদমর্যাদার লোকেরা সাম্রাজ্যের বিভিন্ন বিভাগ পরিচালনা করতেন। এদের মধ্যে অর্থ, যুদ্ধ, বিচার, বন, খনিজ ইত্যাদি বিভাগ ছিল।

5. রাজস্ব বিভাগ: রাজস্ব সংগ্রহ এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা বিভাগ ছিল। 'সামহর্তা' রাজস্ব বিভাগের প্রধান ছিলেন, যিনি কর সংগ্রহ ও রাজকোষ তত্ত্বাবধান করতেন।

6. বিচার ব্যবস্থা: মৌর্য সাম্রাজ্যে বিচার ব্যবস্থা অত্যন্ত কঠোর ও সুসংগঠিত ছিল। প্রধান বিচারক 'ধর্মাধিকারী' এবং 'প্রান্তপাল' এর অধীনে বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হতো।

প্রাদেশিক প্রশাসন ব্যবস্থা:

মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রাদেশিক প্রশাসন ছিল কেন্দ্রীয় প্রশাসনের একটি সম্প্রসারিত রূপ। সাম্রাজ্যকে বিভিন্ন প্রদেশ বা 'অহর' এ ভাগ করা হয়েছিল, এবং প্রতিটি প্রদেশে একজন 'কুমার' বা রাজকুমার দ্বারা শাসিত হতো।

1. প্রদেশপতি: প্রতিটি প্রদেশের শাসক ছিলেন 'প্রদেশপতি', যারা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের প্রতিনিধিত্ব করতেন। এদের কাজ ছিল প্রদেশের শাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং রাজস্ব সংগ্রহ করা।

2. জেলা প্রশাসন: প্রদেশগুলোকে বিভিন্ন জেলায় বিভক্ত করা হতো, এবং প্রতিটি জেলার প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন 'জাতক'। তারা স্থানীয় স্তরের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন।

3. গ্রাম প্রশাসন: মৌর্য সাম্রাজ্যে গ্রাম প্রশাসনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। প্রতিটি গ্রামের প্রধান ছিলেন 'গ্রামিক' বা 'গ্রাম প্রধান'। গ্রামিকরা গ্রামের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, কর সংগ্রহ এবং স্থানীয় বিরোধ নিষ্পত্তি করতেন।

4. শহর প্রশাসন: শহরগুলোতে বিশেষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল, যেখানে 'নাগরক' নামক কর্মকর্তা শহরের শাসন ব্যবস্থা তত্ত্বাবধান করতেন। তারা শহরের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, এবং বাণিজ্য কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।

প্রশাসনিক দপ্তর:

মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রশাসনে বিভিন্ন দপ্তর বা 'অধিকার' ছিল, যা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রশাসনকে সহায়তা করতো।

1. সেনা দপ্তর: সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তির তত্ত্বাবধান ও পরিচালনার জন্য একটি বিশেষ দপ্তর ছিল। 'সেনাপতি' এবং 'নায়ক' এর অধীনে সেনাবাহিনী পরিচালিত হতো।

2. অর্থ দপ্তর: রাজস্ব ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি বিশেষ দপ্তর ছিল, যার প্রধান ছিলেন 'অর্থাধিকারী'।

3. বাণিজ্য দপ্তর: অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনার জন্য একটি দপ্তর ছিল, যার প্রধান ছিলেন 'বাণিজ্যাধিকারী'।

4. সড়ক ও পরিবহন দপ্তর: সড়ক নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিবহন ব্যবস্থার তত্ত্বাবধান করতো 'সড়কাধিকারী'।

5. জনকল্যাণ দপ্তর: জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি বিশেষ দপ্তর ছিল, যা সাধারণ জনগণের সেবা ও উন্নয়নমূলক কাজ করতো।

উপসংহার:

মৌর্য সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রশাসন ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত ও কার্যকর। এই প্রশাসনিক কাঠামোই সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় ও সমৃদ্ধ করে তুলেছিল। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও অশোক মৌর্যের শাসনকালে এই প্রশাসনিক ব্যবস্থা তাদের সাম্রাজ্যকে একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কাঠামো আজও ইতিহাসের পাঠ্যসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।

****9) প্রশ্ন. ভারতীয় শিল্পের ধারায় গান্ধার শিল্পের প্রভাব উল্লেখ করে গান্ধার শিল্পের উপর সংক্ষিপ্ত টাকা লেখ। ৫

গান্ধার শিল্প, যা ভারতীয় শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা, ভারতীয় ইতিহাসের একটি বিশেষ অধ্যায়ে স্থান করে নিয়েছে। এটি বিশেষ করে খ্রিষ্টপূর্ব ১ম শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টাব্দ ৫ম শতাব্দী পর্যন্ত ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে, বিশেষত বর্তমান পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান অঞ্চলে বিকশিত হয়। গান্ধার শিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর হেলেনিস্টিক বা গ্রিক প্রভাব, যা ভারতীয় শিল্পে নতুন ধারার সূচনা ঘটিয়েছে।

গান্ধার শিল্পের সূচনা এবং তার বৈশিষ্ট্য:

গান্ধার শিল্পের উৎপত্তি খ্রিষ্টপূর্ব ১ম শতাব্দী থেকে শুরু হয়। এই সময়ে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল গ্রিক সংস্কৃতির প্রভাবিত ছিল, বিশেষ করে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের আক্রমণ ও পরবর্তীকালে মৈত্রয়ী, শাক্য, এবং কুষাণ সাম্রাজ্যের শাসনকালে। এর ফলে গ্রিক ও ভারতীয় শিল্পের মধ্যে এক নতুন মিশ্রণ দেখা যায়, যার ফলস্বরূপ গান্ধার শিল্পের এক নতুন ধরন সৃষ্টি হয়।

গান্ধার শিল্পের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এর ভাস্কর্য। গান্ধার শিল্পে প্রাকৃতিক দৃশ্য, মানুষের মুখাবয়ব, এবং দেবতার প্রতিকৃতি খুবই বাস্তবিকভাবে চিত্রিত হয়। এসব ভাস্কর্যগুলি সাধারণত চুনাপাথরের তৈরি হত এবং এতে গ্রীক, রোমান এবং পারসিয়ান শিল্পের প্রভাব স্পষ্ট দেখা যায়। বিশেষত, বুদ্ধের মূর্তি এবং অন্যান্য ধর্মীয় দৃশ্যাবলী গান্ধার শিল্পের অন্যতম প্রধান বিষয়।

ভারতীয় শিল্পের উপর গান্ধার শিল্পের প্রভাব:

গান্ধার শিল্প ভারতীয় শিল্পের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল। এর মাধ্যমে ভারতীয় শিল্পে নতুন প্রযুক্তি এবং শৈলী প্রবেশ করেছিল। বিশেষ করে বুদ্ধের মূর্তির প্রতীকী চিত্রণ পরিবর্তন লাভ করে, এবং ভারতীয় ভাস্কর্য শিল্পে প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলি ফুটে ওঠে। গান্ধার শিল্পের প্রভাব ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল, যার প্রমাণ রয়েছে মথুরা, অजन্তা এবং এলোরার গুহা চিত্রকলা ও ভাস্কর্যগুলিতে।

গান্ধার শিল্প ভারতীয় ভাস্কর্য শিল্পকে মানবশরীরের অনুকরণে বাস্তবধর্মী বিশদ চিত্রণ এবং অনুভূতির বহির্প্রকাশের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। বুদ্ধের মূর্তিগুলি, বিশেষ করে গান্ধার শিল্পের মধ্যে, আরও প্রাণবন্ত এবং বৈশ্বিক শৈলীতে চিত্রিত হয়েছিল। বুদ্ধের মুখাবয়ব, তার শান্তি এবং জ্ঞানভরা দৃষ্টি, এই সবকিছুই গান্ধার শিল্পের মাধ্যমে আরও প্রকৃত ও সংবেদনশীলভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

গান্ধার শিল্পের হেলেনিস্টিক প্রভাব:

গান্ধার শিল্পে গ্রীক এবং রোমান প্রভাবের নিদর্শন স্পষ্টভাবে দেখা যায়। গ্রীক মূর্তির পরিপূর্ণতা, শরীরের সুষম অনুপাত, এবং উচ্চমানের কারুকাজের প্রভাব গান্ধার শিল্পের মধ্যে ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে বুদ্ধের মূর্তিগুলির ক্ষেত্রে, যেখানে মুগ্ধকর রূপ এবং বাস্তবিকতা লক্ষ্য করা যায়, সেটি হেলেনিস্টিক প্রভাবেরই ফলস্বরূপ।

গান্ধার শিল্পের কিছু বিশেষ ভাস্কর্য, যেমন বুদ্ধের মূর্তি এবং দেবতাদের প্রতিকৃতির মধ্যে গ্রীক মূর্তির নরম ত্বক, রঙিন পোশাক, এবং বাস্তবিক দৃষ্টি দেখা যায়, যা ভারতীয় শিল্পের জন্য একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। এমনকি গান্ধার শিল্পে বিভিন্ন দেবদেবীর বিভিন্ন মূর্তি নির্মিত হয়েছিল, যেখানে গ্রীক-রোমান ঐতিহ্যের মিশ্রণ অত্যন্ত প্রাধান্য পেয়েছে।

উপসংহার:

গান্ধার শিল্প, ভারতের ঐতিহ্যগত শিল্পের এক উল্লেখযোগ্য শাখা, ভারতীয় শিল্পে হেলেনিস্টিক প্রভাবের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। এর মাধ্যমে ভারতীয় শিল্পে বাস্তবধর্মী চিত্রণ এবং মানবমূর্তির প্রতি নতুন দৃষ্টি প্রকাশিত হয়েছিল। গান্ধার শিল্পের প্রভাব ভারতীয় ভাস্কর্য, চিত্রকলা এবং স্থাপত্যের উপর গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এর ফলে ভারতীয় শিল্পের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল, যা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

****10) প্রশ্ন. কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের কৃতিত্ব বিচার কর। ৫/১০

ভূমিকা:

কনিষ্ক ছিলেন কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্রাট। তাঁর শাসনামলে কুষাণ সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল এবং সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি সাধিত হয়। কনিষ্কের শাসনকালকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে একটি স্বর্ণযুগ হিসেবে ধরা হয়।

সাম্রাজ্য বিস্তার:

কনিষ্কের সাম্রাজ্য বিস্তারের মূল কৃতিত্ব ছিল তার সামরিক শক্তি এবং কৌশলগত বুদ্ধিমত্তা। তিনি বর্তমানের আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং উত্তর ভারতের বেশিরভাগ অংশকে কুষাণ সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসেন। তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তার কেবল ভৌগোলিকভাবেই নয়, বরং অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও ছিল বিশাল। কনিষ্কের সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে ভারতবর্ষের সাথে মধ্য এশিয়া ও রোমান সাম্রাজ্যের বাণিজ্য সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়।

ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অবদান:

কনিষ্কের শাসনামলে বৌদ্ধ ধর্ম একটি বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় গান্ধার শিল্পকলার বিকাশ ঘটে, যা বৌদ্ধ শিল্পের একটি বিশেষ ধারা হিসেবে পরিচিত। কনিষ্কের শাসনামলে বুদ্ধের মূর্তি তৈরি এবং বিভিন্ন স্থাপত্যকর্মের উন্নতি ঘটে।

কনিষ্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল তাঁর বৌদ্ধ ধর্ম পরিষদ আয়োজন। কনিষ্কের সভাপতিত্বে চতুর্থ বৌদ্ধ পরিষদ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের মূলতত্ত্ব ও গ্রন্থগুলো সংগৃহীত ও সংরক্ষিত হয়। এই পরিষদের ফলে বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান শাখার প্রসার ঘটে, যা পরবর্তীতে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত হয়।

অর্থনৈতিক উন্নতি:

কনিষ্কের শাসনামলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধিত হয়। তাঁর শাসনামলে রেশম পথের বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়, যা ভারতবর্ষকে মধ্য এশিয়া এবং রোমান সাম্রাজ্যের সাথে সংযুক্ত করে। এই বাণিজ্য পথের মাধ্যমে মূল্যবান রেশম, মসলা, গহনা ও অন্যান্য সামগ্রী আদান-প্রদান হতো। কনিষ্কের সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্য কেন্দ্র এবং শহরগুলোর উন্নতি ঘটে, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি রচনা করে।

কনিষ্কের শাসনামলে মুদ্রা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। তিনি স্বর্ণ, রৌপ্য এবং ব্রোঞ্জের মুদ্রা প্রচলন করেন, যা বাণিজ্যিক লেনদেনকে সহজতর করে তোলে। তাঁর মুদ্রায় বুদ্ধ, শিব এবং অন্যান্য দেব-দেবীর ছবি অঙ্কিত ছিল, যা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।

রাজনৈতিক ও সামরিক কৃতিত্ব:

কনিষ্কের সামরিক কৃতিত্ব ছিল তাঁর শাসনকালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের সীমান্ত রক্ষায় এবং শত্রুদের প্রতিহত করতে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন করেন। তাঁর সামরিক বাহিনীর দক্ষতা এবং যুদ্ধকৌশলের কারণে তিনি তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত করতে সক্ষম হন। কনিষ্কের সামরিক কৃতিত্ব তাঁর শাসনকালের স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

শিক্ষা ও বিদ্যা:

কনিষ্কের শাসনামলে শিক্ষা ও বিদ্যার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। তিনি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ও শিক্ষাবিদরা শিক্ষাদান করতেন। তাঁর শাসনামলে সংস্কৃত, প্রাকৃত এবং অন্যান্য ভাষার চর্চা বৃদ্ধি পায়। কনিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতায় বিজ্ঞান, চিকিৎসা, গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়।

উপসংহার:

কনিষ্কের কৃতিত্ব বিচারের মাধ্যমে বোঝা যায় যে, তিনি কেবল একজন মহান সাম্রাজ্যবাদী সম্রাটই ছিলেন না, বরং তিনি সংস্কৃতি, ধর্ম, অর্থনীতি এবং বিদ্যার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাঁর শাসনকালে কুষাণ সাম্রাজ্য একটি স্বর্ণযুগে পরিণত হয়েছিল, যা ভারতের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। কনিষ্কের কৃতিত্বের আলোকে বলা যায়, তিনি ছিলেন এক অসাধারণ শাসক, যাঁর শাসনকাল ভারতবর্ষের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

UNIT-3

****11) প্রশ্ন. গুপ্ত যুগের শাসনব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো। ৫/১০

গুপ্ত যুগ (খ্রিস্টীয় ৩২০-৫৫০) প্রাচীন ভারতের অন্যতম সোনালি যুগ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই সময়কালে গুপ্ত সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা এবং প্রশাসনিক কাঠামো ছিল অত্যন্ত সংগঠিত ও শক্তিশালী। গুপ্ত শাসনব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ:

১. কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা:

গুপ্ত সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। সম্রাটরা ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং তাঁদের প্রশাসন পরিচালনার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং উপদেষ্টামণ্ডলী ছিল। সম্রাটদের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য মন্ত্রী পরিষদ ছিল যেখানে প্রধান মন্ত্রী, সামরিক মন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

২. প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা:

গুপ্ত সাম্রাজ্য বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত ছিল এবং প্রতিটি প্রদেশের শাসনকর্তা ছিলেন রাজকুমার বা রাজ্যপাল। এই রাজ্যপালরা সম্রাটের প্রতিনিধি হিসেবে প্রদেশের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। প্রদেশগুলি আবার বিভিন্ন জেলা ও নগরপালদের মাধ্যমে শাসিত হতো।

৩. সামন্তপ্রথা:

গুপ্ত যুগে সামন্তপ্রথা চালু ছিল যেখানে জমিদাররা নিজেদের অঞ্চলে শাসন পরিচালনা করতেন এবং বিনিময়ে সম্রাটকে কর প্রদান করতেন। এই সামন্তপ্রথার ফলে স্থানীয় শাসনব্যবস্থা মজবুত ছিল এবং সাম্রাজ্যের শাসন সহজতর হয়েছিল।

৪. সামরিক ব্যবস্থা:

গুপ্ত সাম্রাজ্যের সামরিক ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। সম্রাটের অধীনে একটি বৃহৎ এবং সুসজ্জিত সেনাবাহিনী ছিল। এই সেনাবাহিনীতে পদাতিক, অশ্বারোহী, এবং রথ সৈন্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। এছাড়াও, সম্রাটদের নিজস্ব দেহরক্ষী বাহিনীও ছিল।

৫. আইন ও বিচার ব্যবস্থা:

গুপ্ত যুগে আইন ও বিচার ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত ছিল। সম্রাটরা আইন প্রণয়ন করতেন এবং তাদের রক্ষার্থে বিচারক নিয়োগ করা হতো। রাজ্যপাল ও অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তারা স্থানীয় স্তরে বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। সামাজিক ও ধর্মীয় বিধি-নিষেধ মেনে চলার বিষয়টি গুরুত্ব পেত।

৬. কর ব্যবস্থা:

গুপ্ত যুগের কর ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। সম্রাট বিভিন্ন ধরনের কর আরোপ করতেন যেমন ভূমি কর, বাণিজ্য কর, এবং কারিগরি কর। কৃষিজমির ওপর প্রধান কর ছিল ‘ভাগদা’ যেখানে কৃষকরা উৎপাদিত ফসলের একাংশ সম্রাটকে দিতেন। এই কর ব্যবস্থা সাম্রাজ্যের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করেছিল।

৭. অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক উন্নয়ন:

গুপ্ত যুগে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক উন্নয়ন ছিল উল্লেখযোগ্য। গুপ্ত সম্রাটরা কৃষি, শিল্প, এবং বাণিজ্যকে উৎসাহিত করতেন। মুদ্রার প্রচলন ছিল অত্যন্ত সুশৃঙ্খল এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলো ছিল সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত। রেশম, মসলিন, ও অন্যান্য পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হতো যা সাম্রাজ্যের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছিল।

৮. শিক্ষার প্রসার:

গুপ্ত যুগে শিক্ষার প্রসারও ছিল উল্লেখযোগ্য। এই সময়ে নালন্দা, তক্ষশিলা, এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উচ্চশিক্ষার প্রচলন ছিল। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা ছিল ব্যাপক এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছিল।

৯. ধর্ম ও সংস্কৃতি :

গুপ্ত যুগে হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম এবং জৈনধর্মের চর্চা ছিল সমানভাবে। সম্রাটরা ধর্মীয় সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করতেন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এই সময়ে মন্দির নির্মাণ ও শিল্পকলার প্রসারও হয়েছিল।

১০. সামাজিক ব্যবস্থা:

গুপ্ত যুগের সামাজিক ব্যবস্থা ছিল চারবর্ণভিত্তিক। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, এবং শূদ্র—এই চারটি বর্ণের মানুষদের নির্দিষ্ট অধিকার ও দায়িত্ব ছিল। নারী শিক্ষার প্রসারও এই সময়ে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং তাদের সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হয়েছিল।

উপসংহার:

গুপ্ত যুগের শাসনব্যবস্থা ছিল প্রাচীন ভারতের অন্যতম সুশৃঙ্খল ও কার্যকরী শাসনব্যবস্থা। সম্রাটদের ক্ষমতা, প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা, সামরিক শক্তি, কর ও বিচার ব্যবস্থা, এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন—এই সবকিছু মিলিয়ে গুপ্ত যুগ প্রাচীন ভারতের এক স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই সময়ে ভারতবর্ষে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটেছিল যা পরবর্তীকালে ভারতীয় সভ্যতার ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।

****12) প্রশ্ন. দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের রাজনৈতিক কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর। ১০/৫

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য, যিনি চন্দ্রগুপ্ত দ্বিতীয় নামেও পরিচিত, গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলেন। তার শাসনামলে (৩৭৫-৪১৫ খ্রিষ্টাব্দ) গুপ্ত সাম্রাজ্য তার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায়। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের রাজনৈতিক কৃতিত্ব ও সাম্রাজ্য পরিচালনার দক্ষতা গুপ্ত সাম্রাজ্যকে ভারতের ইতিহাসে একটি সোনালী যুগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার কৃতিত্বগুলো নিম্নরূপে বিশ্লেষণ করা যায়:

১. সাম্রাজ্যের বিস্তার:

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য তার সাম্রাজ্য বিস্তারে বিশেষভাবে সফল ছিলেন। তার শাসনামলে গুপ্ত সাম্রাজ্য উত্তর ভারত থেকে পশ্চিম ভারতের কিছু অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তিনি শক জাতিকে পরাজিত করে মালওয়া, গুজরাট এবং সৌরাষ্ট্র অঞ্চলে শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। শক রাজাকে পরাজিত করে তিনি "শকারি" উপাধি লাভ করেন।

২. শক্তিশালী সামরিক ক্ষমতা:

চন্দ্রগুপ্ত দ্বিতীয়ের সামরিক ক্ষমতা তার সাম্রাজ্যের সুরক্ষায় এবং বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি একটি শক্তিশালী ও সুসংগঠিত সেনাবাহিনী গঠন করেন যা তাকে বিভিন্ন যুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করে। শক রাজ্যের পতন এবং অন্যান্য সাম্রাজ্যবিস্তারের কৃতিত্ব তার সামরিক দক্ষতার প্রতিফলন।

৩. কূটনৈতিক সম্পর্ক:

চন্দ্রগুপ্ত দ্বিতীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। তিনি অন্যান্য শক্তিশালী রাজ্য এবং সাম্রাজ্যের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেন। উদাহরণস্বরূপ, তার কন্যা প্রবাসীর সাথে বালির রাজা রুদ্রসেনের বিবাহ কূটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করে। এই ধরনের সম্পর্ক তার সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

৪. অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি:

চন্দ্রগুপ্ত দ্বিতীয়ের শাসনামলে গুপ্ত সাম্রাজ্য অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। কৃষি, শিল্প, এবং বাণিজ্যে উন্নতি ঘটে। বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোর উন্নয়ন এবং সড়ক নির্মাণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। শক রাজ্য বিজয়ের ফলে পশ্চিম উপকূলের বাণিজ্য পথগুলোর নিয়ন্ত্রণ তার হাতে আসে, যা সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করে।

৫. প্রশাসনিক দক্ষতা:

চন্দ্রগুপ্ত দ্বিতীয়ের প্রশাসনিক দক্ষতা তার সাম্রাজ্যকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করতে সহায়ক হয়। তিনি একটি দক্ষ ও সুসংগঠিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলেন যা সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের উপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। তার প্রশাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রশাসনের মধ্যে সুসমন্বয়।

৬. সাংস্কৃতিক উন্নয়ন:

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের শাসনামলে সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রয়েছে। তার রাজদরবারে কালিদাস, বাণভট্ট, এবং আর্যভট্টের মতো মহাকবি, লেখক এবং বিজ্ঞানীরা ছিলেন। সংস্কৃত সাহিত্য, বিজ্ঞান, এবং গণিতের অগ্রগতি তার শাসনামলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, যা "গুপ্ত যুগের স্বর্ণযুগ" হিসেবে পরিচিত।

৭. শিল্প ও স্থাপত্য:

চন্দ্রগুপ্ত দ্বিতীয়ের শাসনামলে শিল্প ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটে। অজন্তার গুহাচিত্র এবং অন্যান্য স্থাপত্যকর্ম এই সময়ের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এই স্থাপত্যকর্মগুলি তার শাসনামলের শৈল্পিক উৎকর্ষতার প্রমাণ।

৮. ধর্মীয় সহিষ্ণুতা:

চন্দ্রগুপ্ত দ্বিতীয় ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং উদারতার প্রতীক ছিলেন। তার শাসনামলে হিন্দু ধর্মের পাশাপাশি বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মও সমানভাবে পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। তার রাজদরবারে বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধি এবং পণ্ডিতদের সমাগম হয়, যা সাম্রাজ্যের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করে।

৯. মুদ্রা ও শিলালিপি:

চন্দ্রগুপ্ত দ্বিতীয়ের শাসনামলে প্রবর্তিত মুদ্রা ও শিলালিপি তার শাসনামলের ইতিহাস ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ দিক প্রতিফলিত করে। তার মুদ্রাগুলিতে তার শাসনকালের বৈশিষ্ট্য এবং সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পরিচয় মেলে। শিলালিপিগুলি তার বিভিন্ন বিজয় ও কৃতিত্বের দলিল হিসেবে কাজ করে।

উপসংহার:

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের রাজনৈতিক কৃতিত্ব তার সাম্রাজ্য বিস্তার, সামরিক দক্ষতা, প্রশাসনিক ক্ষমতা, এবং সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। তার শাসনামলে গুপ্ত সাম্রাজ্য একটি শক্তিশালী, সমৃদ্ধ এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উন্নত সাম্রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তার কৃতিত্বগুলি শুধু তার সময়ের নয়, পরবর্তী সময়েরও ভারতীয় ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেলে।

UNIT-4

****12) প্রশ্ন. প্রাচীন ভারতে চোলদের সামুদ্রিক কার্যকলাপের উপর একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ। (৫)

প্রাচীন ভারতের অন্যতম সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিল চোল সাম্রাজ্য। চোলরা তাদের সামুদ্রিক কার্যকলাপের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ছিল। চোলদের সামুদ্রিক কার্যকলাপ প্রধানত বাণিজ্য ও সামরিক অভিযানের জন্য ব্যবহৃত হত। তাদের সামুদ্রিক কার্যকলাপের উপর সংক্ষিপ্ত টীকা নিচে দেওয়া হল:

চোল সাম্রাজ্যের সমুদ্রবাণিজ্য:

চোল সাম্রাজ্য সমুদ্রপথে বাণিজ্যে বিশেষভাবে পারদর্শী ছিল। তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চীন এবং শ্রীলঙ্কার সাথে বিস্তৃত বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। চোলরা নৌবাহিনী গঠন করে এবং বন্দর নগরীগুলোতে নৌবাণিজ্যের সুবিধা সৃষ্টি করেছিল। তাদের বাণিজ্যের প্রধান পণ্যগুলির মধ্যে ছিল মসলা, সোনা, রৌপ্য, হাতির দাঁত, এবং বহুমূল্য পাথর।

নৌবাহিনী ও সামুদ্রিক অভিযান:

চোলরা সমুদ্রপথে সামরিক অভিযানের জন্য একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তুলেছিল। তাদের নৌবাহিনী ছিল সুসংগঠিত এবং অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিল। চোল রাজা রাজেন্দ্র চোল প্রথম (১০১২-১০৪৪ খ্রিস্টাব্দ) এর অধীনে, চোল নৌবাহিনী শ্রীবিজয় সাম্রাজ্য (বর্তমান ইন্দোনেশিয়া) আক্রমণ করে এবং তাদের সামুদ্রিক বাণিজ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

বন্দর নগরী ও সমুদ্র পথের উন্নয়ন:

চোলরা তাদের সামুদ্রিক কার্যকলাপের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন বন্দর নগরী গড়ে তুলেছিল। কারিকাল, কুড্ডালোর, এবং নগাপত্তিনম ছিল তাদের প্রধান বন্দর নগরী। এই বন্দর নগরীগুলোর মাধ্যমে চোলরা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যুক্ত হয়েছিল। এছাড়াও, তারা সমুদ্র পথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করেছিল, যা বাণিজ্যিক ও সামরিক কার্যক্রমকে সহজতর করেছিল।

সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিনিময়:

চোল সাম্রাজ্যের সামুদ্রিক কার্যকলাপ শুধু বাণিজ্য ও সামরিক অভিযানে সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা বিভিন্ন দেশের সাথে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিনিময়ও করেছিল। চোলরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দির স্থাপন করেছিল এবং ভারতীয় সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রচার করেছিল।

অর্থনৈতিক প্রভাব:

চোলদের সামুদ্রিক কার্যকলাপ তাদের অর্থনীতির উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। সমুদ্রপথে বাণিজ্যের মাধ্যমে তারা বিশাল পরিমাণে সম্পদ আহরণ করেছিল। এই সম্পদ তাদের সাম্রাজ্যকে সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী করতে সহায়ক ছিল। এছাড়াও, তাদের নৌবাহিনীর শক্তি ও সমুদ্রপথে বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ তাদের সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক শক্তিকে বৃদ্ধি করেছিল।

উপসংহার:

প্রাচীন ভারতের চোল সাম্রাজ্যের সামুদ্রিক কার্যকলাপ তাদের সমৃদ্ধি ও শক্তির অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। তাদের সমুদ্রপথে বাণিজ্য, সামরিক অভিযান, এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। চোলদের সামুদ্রিক কার্যকলাপ প্রাচীন ভারতের সমুদ্রবাণিজ্যের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।

****13) প্রশ্ন. স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার উল্লেখ করে চোল শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে লেখো।৫/১০

ভারতবর্ষের ইতিহাসে চোল সাম্রাজ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। প্রাচীন তামিল অঞ্চলে চোল সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল এবং তাদের শাসনব্যবস্থা প্রাচীন ভারতের অন্যতম উন্নত ও সুসংগঠিত শাসনব্যবস্থার মধ্যে একটি ছিল। চোল সাম্রাজ্য তামিলনাড়ু, কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং কর্ণাটক অঞ্চলে বিস্তৃত ছিল। চোল শাসকদের রাজত্বকাল ছিল খ্রিস্টীয় নবম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত। এই সময়ে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা বিশেষভাবে উন্নত ছিল এবং এটি চোল শাসনব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল।

স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা:

চোল শাসনব্যবস্থার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরিচালিত হত। গ্রামগুলিকে প্রশাসনিক একক হিসেবে গণ্য করা হত এবং প্রতিটি গ্রামের নিজস্ব স্বায়ত্তশাসন ছিল। এই স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থাকে 'উর' (গ্রাম) বা 'সবাহ' বলা হত। গ্রামবাসীদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে গ্রামগুলির শাসন কাজ পরিচালিত হত।

গ্রাম পরিষদ:

গ্রাম পরিষদ বা 'সবাহ' ছিল স্থানীয় প্রশাসনের মূল ভিত্তি। প্রতিটি গ্রামে একটি সবাহ গঠিত হত, যা গ্রামের প্রশাসনিক ও বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করত। সবাহ সদস্যদের নির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট মানদণ্ড ছিল। সাধারণত গ্রামের প্রবীণ ও সম্মানিত ব্যক্তিরাই এই সবাহ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হতেন। সবাহ বিভিন্ন কার্যক্রম যেমন রাজস্ব সংগ্রহ, জল ব্যবস্থাপনা, সড়ক নির্মাণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা ইত্যাদি পরিচালনা করত।

নির্বাচন প্রক্রিয়া:

সবাহ সদস্যদের নির্বাচন প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক। প্রাচীন চোল সাম্রাজ্যে 'কুডাভোলাই' নামক একটি পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হত। এই পদ্ধতিতে গ্রামের যোগ্য ব্যক্তিদের নাম একটি মাটির পাত্রে রাখা হত এবং সেখান থেকে লটারির মাধ্যমে সদস্য নির্বাচন করা হত। এই নির্বাচন প্রক্রিয়া গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থাকে অধিকতর গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ করত।

চোল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রশাসন:

চোল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় প্রশাসন ছিল রাজা বা সম্রাটের নেতৃত্বে পরিচালিত। সম্রাট ছিলেন সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি এবং তার অধীনে ছিল বিভিন্ন মন্ত্রী ও প্রশাসনিক কর্মচারী। মন্ত্রীরা বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব পালন করতেন যেমন রাজস্ব, যুদ্ধ, বিচার, এবং ধর্মীয় কার্যক্রম।

প্রাদেশিক প্রশাসন:

চোল সাম্রাজ্যকে বিভিন্ন প্রদেশে ভাগ করা হত এবং প্রতিটি প্রদেশের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতেন 'বেলাল' বা 'মণ্ডল'। প্রদেশগুলিকে আবার বিভিন্ন 'কোট্টাম' বা জেলায় ভাগ করা হত এবং প্রতিটি জেলার প্রশাসনের দায়িত্বে ছিলেন 'কোট্টমাল'। এছাড়াও প্রতিটি জেলার নীচে বিভিন্ন গ্রাম ছিল এবং গ্রামগুলির প্রশাসনিক দায়িত্ব ছিল গ্রাম পরিষদ বা সবাহর উপর।

চোল শাসনব্যবস্থার গুরুত্ব:

চোল শাসনব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল তাদের উন্নত প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন। এই ব্যবস্থা চোল সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করেছিল। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রামবাসীরা তাদের নিজস্ব সমস্যার সমাধান করতে পারত এবং প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে অংশগ্রহণ করতে পারত। এই ব্যবস্থা চোল সাম্রাজ্যের উন্নয়নে ও সামাজিক স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

উপসংহার:

চোল সাম্রাজ্যের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল যা তাদের শাসনব্যবস্থাকে বিশেষ ও উন্নত করেছিল। এই ব্যবস্থা প্রাচীন ভারতের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় একটি মডেল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। চোল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে এই স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা তাদের শাসনকালকে সাফল্যমণ্ডিত ও স্থায়ী করেছিল। চোল সাম্রাজ্যের এই শাসনব্যবস্থা থেকে বর্তমান সমাজও অনেক কিছু শিখতে পারে এবং তা থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।

1 thought on “Kalyani University BA 1st Semester History Minor Long Question Answer 2024-2025”

Leave a Comment

Suggestion Buy