এখানে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সিলেবাস অনুযায়ী সাজানো আছে
University of Kalyani Suggestion
Political Science Major Long Question Answer 2024-2025
Course Code- POL-M-T-3
Indian Political Thought (Ancient and Medieval)
UNIT-1 • প্রাচীন ভারতীয় রাজনৈতিক ধারণা
****1) প্রশ্ন. প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রদর্শনের মূল উৎসগুলি সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা কর। ১০
Kalyani University BA 3rd Semester Political Science Major Long Question Answer (SAQ Suggestion) PDF টি পেতে.. আপনি ১১ টাকা পেমেন্ট করুন। পেমেন্টের পর এক সেকেন্ডের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সাজেশনটি পাবেন। টাকা টি পেমেন্ট করার জন্য নিচে PAY বাটনে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।
প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রদর্শনের একটি সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় ইতিহাস রয়েছে। এটির মূল উৎসগুলি বহু শতাব্দী ধরে বিকশিত হয়েছে এবং ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন দিকগুলি সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। এখানে আমরা প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রদর্শনের কয়েকটি প্রধান উৎস সম্পর্কে আলোচনা করব।
১. বেদ ও বেদাঙ্গ:
বেদ হল প্রাচীন ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন এবং পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। এগুলি হিন্দু ধর্মের মূল উৎস হিসাবে বিবেচিত হয় এবং ধর্মীয়, সামাজিক, এবং রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে। বেদাঙ্গগুলি হল বেদগুলির পরিপূরক গ্রন্থ, যা বেদগুলির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয়।
২. মহাকাব্য: রামায়ণ ও মহাভারত:
রামায়ণ ও মহাভারত হল দুটি প্রধান মহাকাব্য, যা প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রদর্শনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। রামায়ণে রাম রাজ্যের আদর্শ শাসনের গল্প রয়েছে, যেখানে ধর্ম, ন্যায় ও আদর্শের মিশ্রণ দেখা যায়। মহাভারতে কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে যুদ্ধে রাজনীতি, ধর্ম ও সমাজের বিভিন্ন দিকের বিশদ বিবরণ রয়েছে।
৩. পুরাণ:
পুরাণগুলি হল বিভিন্ন ঐতিহাসিক কাহিনী ও ঘটনাসমূহের সংগ্রহ, যা ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা প্রদান করে। এগুলি বিভিন্ন দেব-দেবী, রাজারাজড়া এবং ঐতিহাসিক ঘটনার উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে এবং রাষ্ট্রের ধারণা ও শাসন পদ্ধতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করে।
৪. অর্খশাস্ত্র:
কৌটিল্যের অর্খশাস্ত্র হল প্রাচীন ভারতের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গ্রন্থ। এটি রাষ্ট্র পরিচালনা, রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন, এবং যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করে। অর্খশাস্ত্রে রাষ্ট্রের পরিচালনা পদ্ধতি, রাজা ও মন্ত্রিসভার কর্তব্য, অর্থনীতি ও বাণিজ্য, এবং যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করা হয়েছে।
৫. ধর্মশাস্ত্র:
ধর্মশাস্ত্রগুলি হল প্রাচীন ভারতের আইন ও নৈতিকতার গ্রন্থসমূহ, যা সমাজের বিভিন্ন দিকের উপর নিয়ম ও নীতিমালা প্রদান করে। মনুস্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি প্রভৃতি ধর্মশাস্ত্রসমূহ রাজনীতি, সমাজ ও আইন সম্পর্কে বিস্তৃত নির্দেশনা প্রদান করে।
৬. বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্য:
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সাহিত্যেও প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রদর্শনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস পাওয়া যায়। ত্রিপিটক ও জৈন আগম সাহিত্য রাষ্ট্র পরিচালনা ও শাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিশদ বিবরণ প্রদান করে।
৭. নীতিশাস্ত্র:
নীতিশাস্ত্রগুলি রাজনীতি, শাসন ও নৈতিকতার উপর ভিত্তি করে রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ। পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ ইত্যাদি নীতিশাস্ত্রসমূহ রাজনীতির বিভিন্ন দিক, রাজা ও প্রজার সম্পর্ক, এবং রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় কাহিনী প্রদান করে।
উপসংহার:
প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রদর্শনের মূল উৎসগুলি ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। বেদ, মহাকাব্য, পুরাণ, অর্খশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র, বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্য, এবং নীতিশাস্ত্র এই সমস্ত গ্রন্থসমূহের মাধ্যমে প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্র পরিচালনা, শাসন পদ্ধতি, রাজনীতি ও সমাজের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা পাওয়া যায়। এই উৎসগুলি প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রদর্শনের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও তার বৈচিত্র্যময় দিকগুলির প্রতিফলন।
****2) প্রশ্ন. ‘মনুস্মৃতিতে’ বর্ণিত ‘বর্ণ’ ও ‘আশ্রম’-এর ধারণার উপর একটি টীকা লেখ। ৫
‘মনুস্মৃতি’ হিন্দু ধর্মের প্রাচীনতম ও গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থগুলির একটি, যা মনু কর্তৃক রচিত বলে জানা যায়। এই গ্রন্থে হিন্দু সমাজের বিভিন্ন বিধি-নিষেধ, সামাজিক দায়িত্ব এবং ধর্মীয় আচরণগুলি নির্ধারিত হয়েছে। এই গ্রন্থে বর্ণ ও আশ্রমের ধারণা বিশেষভাবে উল্লেখিত হয়েছে, যা হিন্দু সমাজের কাঠামো ও মানসিকতা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বর্ণের ধারণা:
মনুস্মৃতিতে সমাজকে চারটি প্রধান বর্ণে বিভক্ত করা হয়েছে: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। 1.ব্রাহ্মণ: ব্রাহ্মণদের প্রধান কাজ ছিল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা, বেদ পাঠ করা এবং শিক্ষা প্রদান করা। তাদেরকে জ্ঞানী ও ধর্মজ্ঞ হিসেবে সমাজে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়েছিল।
2.ক্ষত্রিয়: ক্ষত্রিয়রা ছিলেন যোদ্ধা ও শাসক শ্রেণি। তাদের দায়িত্ব ছিল রাজ্য রক্ষা করা, শত্রুর সাথে যুদ্ধ করা এবং রাজ্য পরিচালনা করা।
3. বৈশ্য: বৈশ্যদের কাজ ছিল কৃষি, পশুপালন ও ব্যবসা। তারা অর্থনৈতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে সমাজের সমৃদ্ধিতে অবদান রাখতেন।
4. শূদ্র: শূদ্ররা প্রধানত শ্রমিক শ্রেণি হিসেবে কাজ করতেন। তারা অন্যান্য বর্ণের সেবা করতেন এবং তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য বিভিন্ন প্রকার শারীরিক পরিশ্রম করতেন।
এই চারটি বর্ণের মধ্যে সামাজিক ও ধর্মীয় কার্যাবলীর ভাগাভাগি ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ছিল। প্রতিটি বর্ণের নিজস্ব দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারিত ছিল, যা সমাজের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা ও সুশৃঙ্খলতার ভিত্তি গঠন করেছিল।
আশ্রমের ধারণা:
মনুস্মৃতিতে মানবজীবনকে চারটি আশ্রমে বিভক্ত করা হয়েছে: ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাস। 1.ব্রহ্মচর্য আশ্রম: জীবনের প্রথম পর্যায়ে, শিক্ষালাভ ও আত্মসংযমের মাধ্যমে নিজের চরিত্র গঠন করা হয়। এই সময়ে ছাত্ররা গুরুকুলে বাস করে বেদ ও অন্যান্য ধর্মীয় শাস্ত্র অধ্যয়ন করে।
2.গার্হস্থ্য আশ্রম: শিক্ষার পর গার্হস্থ্য জীবন শুরু হয়। এই সময়ে ব্যক্তি বিবাহ করে, পরিবার গঠন করে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালন করে। গার্হস্থ্য আশ্রমকে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় পর্যায় হিসেবে গণ্য করা হয়।
3.বানপ্রস্থ আশ্রম: মধ্য বয়সে, ব্যক্তিরা ধীরে ধীরে সংসার ত্যাগ করে এবং অরণ্যে গিয়ে ধর্মচর্চা ও ধ্যানের মাধ্যমে আত্মজ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করে। এটি এক ধরনের প্রস্তুতি পর্যায়, যা ব্যক্তিকে সন্ন্যাসের জন্য প্রস্তুত করে।
4. সন্ন্যাস আশ্রম: জীবনের শেষ পর্যায়ে, ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করে। তারা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে মনোনিবেশ করে এবং মোক্ষ লাভের চেষ্টা করে।
বর্ণ ও আশ্রমের সমন্বয়:
মনুস্মৃতিতে বর্ণ ও আশ্রমের ধারণাগুলি পরস্পর সম্পর্কিত। প্রতিটি বর্ণের জন্য নির্ধারিত আশ্রম অনুসারে জীবনযাপন করতে বলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে চারটি আশ্রমের সমস্ত পর্যায় পালন বাধ্যতামূলক ছিল, যেখানে শূদ্রদের জন্য কেবলমাত্র গার্হস্থ্য আশ্রম পালনের নির্দেশ ছিল।
বর্ণ ও আশ্রমের এই সমন্বয় হিন্দু সমাজের কাঠামো ও ধর্মীয় জীবনচর্চার মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। এই ব্যবস্থা সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিকে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছে এবং সামাজিক ও ধর্মীয় স্থিতিশীলতা রক্ষা করেছে।
উপসংহার:
‘মনুস্মৃতিতে’ বর্ণিত বর্ণ ও আশ্রমের ধারণা হিন্দু সমাজের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এই ধারণাগুলি সমাজের স্থিতিশীলতা ও সুশৃঙ্খলতার ভিত্তি রচনা করেছে এবং প্রতিটি ব্যক্তিকে তাদের জীবনযাত্রার উদ্দেশ্য ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করেছে। যদিও আধুনিক সমাজে এই প্রথাগুলি প্রায় বিলুপ্তপ্রায়, তবুও ইতিহাসের পাতায় এই ধারণাগুলির গুরুত্ব অপরিসীম।
****3) প্রশ্ন. প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তার উৎস বিষয়ে টীকা লেখ। ৫
প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তা একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক বিষয় যা প্রাচীন ভারতের সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিকশিত হয়েছে। এই রাষ্ট্রচিন্তার উৎসগুলির মধ্যে বেদ, উপনিষদ, ধর্মশাস্ত্র, মহাকাব্য, এবং প্রাচীন ভারতীয় দর্শন উল্লেখযোগ্য।
১. বেদ এবং উপনিষদ:
বেদ এবং উপনিষদ প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান উৎস। বেদগুলি ভারতের প্রাচীনতম ধর্মীয় গ্রন্থ যা সমগ্র সমাজের বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেয়। ঋগ্বেদে রাজা এবং রাজার দায়িত্ব সম্পর্কে উল্লেখ আছে। রাজাকে বলা হয়েছে 'রাজন' এবং তাঁর প্রধান কাজ ছিল রাজ্য পরিচালনা করা এবং প্রজাদের সুরক্ষা দেয়া।
উপনিষদগুলি বেদান্ত দর্শনের মূল গ্রন্থ যা আধ্যাত্মিক এবং নৈতিক দিক থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার ধারণা প্রদান করে। এখানে আত্মা, ব্রহ্ম, এবং মোক্ষ সম্পর্কে গভীর তত্ত্ব আলোচনা করা হয়েছে যা রাষ্ট্রচিন্তার আধ্যাত্মিক ভিত্তি স্থাপন করে।
২. ধর্মশাস্ত্র:
ধর্মশাস্ত্রগুলি, বিশেষ করে মনুসংহিতা এবং অর্থশাস্ত্র, প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তার অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। মনুসংহিতা প্রাচীন হিন্দু আইনশাস্ত্র যা রাজনীতি, সমাজনীতি এবং নৈতিকতার উপর বিভিন্ন বিধান প্রদান করে। এখানে রাজা এবং তাঁর মন্ত্রিসভা কিভাবে রাজ্য পরিচালনা করবেন তা নির্ধারিত করা হয়েছে।
অর্থশাস্ত্র, যা চাণক্য বা কৌটিল্য রচিত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং অর্থনীতির উপর একটি বিস্তৃত গ্রন্থ। এটি রাজ্য পরিচালনার কৌশল, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, সামরিক কৌশল এবং কূটনীতি সম্পর্কে বিশদ নির্দেশনা প্রদান করে। অর্থশাস্ত্রের মূলমন্ত্র ছিল রাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধি এবং সুরক্ষা।
৩. মহাকাব্য:
মহাকাব্য রামায়ণ এবং মহাভারত প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তার উপর বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। রামায়ণ কাব্যে রাম রাজ্যের আদর্শ মডেল তুলে ধরা হয়েছে যেখানে রাজা রাম জনগণের কল্যাণের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেন। মহাভারতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ এবং পাণ্ডবদের রাজ্য পুনর্দখলের কাহিনী রাজনীতি এবং যুদ্ধনীতির গভীর তত্ত্ব প্রদান করে।
৪. প্রাচীন ভারতীয় দর্শন:
প্রাচীন ভারতীয় দর্শন যেমন সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা এবং বেদান্তও রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই দর্শনগুলি সামাজিক ও রাষ্ট্রিক নীতি নির্ধারণে নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক দিক থেকে নির্দেশনা প্রদান করে। সাংখ্য এবং যোগ দর্শনে আত্মার শুদ্ধি এবং সামাজিক দায়িত্বের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
৫. ইতিহাস এবং সমাজব্যবস্থা:
প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তা বিকাশে ইতিহাস এবং সমাজব্যবস্থাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মগধ, মৌর্য, এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যের শাসনকালে রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে রাষ্ট্রচিন্তার বাস্তবায়ন হয়েছে। এই সময়কালে রাজারা প্রজাদের কল্যাণ, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং সামরিক শক্তি বৃদ্ধির উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
উপসংহার:
প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তার উৎসগুলি বহুমুখী এবং বহুস্তর বিশিষ্ট। বেদ, উপনিষদ, ধর্মশাস্ত্র, মহাকাব্য এবং প্রাচীন ভারতীয় দর্শন এই রাষ্ট্রচিন্তার ভিত্তি স্থাপন করেছে। এই চিন্তাধারাগুলি শুধু প্রাচীন ভারতীয় সমাজকে নয়, বর্তমান সমাজেও প্রভাব ফেলেছে। রাষ্ট্রের নীতি, শাসনব্যবস্থা এবং সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে এই চিন্তাধারাগুলি আজও প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ।
****4) প্রশ্ন. প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রদর্শনের উৎস হিসাবে মহাকাব্য সমূহের ভূমিকার মূল্যায়ন কর।৫
ভারতীয় সভ্যতা তার দীর্ঘ ইতিহাস ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য সুপরিচিত। এই সভ্যতার অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক হলো প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রদর্শন, যা বিভিন্ন মহাকাব্যের মাধ্যমে প্রচলিত ও বিকশিত হয়েছে। মহাকাব্যগুলি যেমন "রামায়ণ" ও "মহাভারত" শুধু সাহিত্যিক কীর্তি নয়, তারা প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রদর্শনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসাবেও বিবেচিত হয়।
১. মহাকাব্যের পরিচিতি ও প্রেক্ষাপট:
"রামায়ণ" ও "মহাভারত" হল ভারতীয় মহাকাব্যের দুটি প্রধান রচনা। রামায়ণ মহর্ষি বাল্মীকি কর্তৃক রচিত, যা রাম ও সীতার গল্প নিয়ে গঠিত। অপরদিকে, মহাভারত মহর্ষি বেদব্যাসের রচনা, যা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ও কৌরব-পাণ্ডবদের কাহিনী নিয়ে রচিত। এই মহাকাব্যগুলি শুধু কাহিনী বা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের বর্ণনা নয়, তারা প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক চিন্তাধারার প্রতিফলন।
২. মহাকাব্যের রাজনৈতিক চিন্তাধারা:
মহাকাব্যগুলিতে প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক দর্শনের বিভিন্ন দিক পাওয়া যায়। রামায়ণে রামের রাজ্যাভিষেক, বনবাস, রাবণবধ ও অযোধ্যার শাসন ব্যবস্থার বিবরণ রয়েছে। এই কাহিনী রাষ্ট্র পরিচালনা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, ন্যায়পরায়ণতা ও নৈতিকতার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। রামের চরিত্র একজন আদর্শ রাজা হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছে, যিনি ধর্ম ও ন্যায়ের অনুসরণে আপোষহীন ছিলেন।
মহাভারতে রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলের অনেক দিক ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কৃষ্ণের গীতা উপদেশ, যুদ্ধে ধর্মের গুরুত্ব ও নীতির আলোচনা মহাভারতের অন্যতম মূল বিষয়। এখানে ধর্ম ও নীতির সাথে সাথে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক, যুদ্ধের নিয়ম-কানুন ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
৩. সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা:
মহাকাব্যগুলি সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষারও গুরুত্বপূর্ণ উৎস। রামায়ণে রাম-সীতা, লক্ষ্মণ-উর্মিলা, ভরত-রাম প্রভৃতি চরিত্রের মাধ্যমে পারিবারিক বন্ধন, ন্যায়-অন্যায়, সতীত্ব ও ধর্মের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। রামায়ণে রামের বনবাস ও সীতার অগ্নিপরীক্ষা ধর্ম ও নীতির প্রতি তাঁদের অটল বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করে।
মহাভারতে কৌরব-পাণ্ডবদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা, কর্ণের দানশীলতা প্রভৃতি ঘটনাগুলি সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মহাভারতে গীতা উপদেশ মানবজীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও নৈতিকতার মূল মন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয়।
৪. রাষ্ট্রদর্শনের উপর মহাকাব্যের প্রভাব:
মহাকাব্যগুলি প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রদর্শনের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। রামায়ণ ও মহাভারতের শিক্ষাগুলি রাষ্ট্র পরিচালনা, নৈতিকতা, সামাজিক বন্ধন ও ব্যক্তিগত আচার-আচরণের ভিত্তি রচনা করেছে। এই মহাকাব্যগুলি ভারতীয় রাষ্ট্রদর্শনের মৌলিক উপাদান সরবরাহ করেছে এবং প্রাচীন ভারতের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
মহাকাব্যগুলির মাধ্যমে প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রদর্শনের যে মৌলিক দিকগুলি প্রতিফলিত হয়েছে, তা আধুনিক সমাজেও প্রাসঙ্গিক। ন্যায়পরায়ণতা, ধর্মানুরাগ, নৈতিকতা ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা আজও রাষ্ট্র পরিচালনা ও ব্যক্তিগত জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
উপসংহার:
প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রদর্শনের বিকাশে মহাকাব্যগুলির ভূমিকা অনস্বীকার্য। রামায়ণ ও মহাভারতের মাধ্যমে প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক দর্শনের যে শিক্ষা আমরা পাই, তা আমাদের আজকের সমাজেও প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। মহাকাব্যগুলির এই অমর রচনা প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রদর্শনের একটি মূল্যবান উৎস, যা আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে।
****5) প্রশ্ন. প্রাচীন ভারতে রাষ্ট্রনীতির পরিভাষা হিসাবে 'দণ্ডনীতির' উপর একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ। ৫
প্রাচীন ভারতে রাষ্ট্রনীতি ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে 'দণ্ডনীতি' এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করত। 'দণ্ডনীতি' শব্দটি এসেছে 'দণ্ড' এবং 'নীতি' এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে, যেখানে 'দণ্ড' মানে শাস্তি বা বিচার এবং 'নীতি' মানে নীতি বা বিধান। অর্থাৎ, দণ্ডনীতি হল সেই নীতি বা বিধান যা অপরাধ ও শাস্তির ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করে। এটি রাজ্যের আইন ও শৃঙ্খলার একটি অপরিহার্য অংশ ছিল এবং সমাজের স্থিতিশীলতা ও ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
১. দণ্ডনীতির সংজ্ঞা ও তাৎপর্য:
দণ্ডনীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এবং অপরাধ প্রতিরোধ করা। এর মাধ্যমে রাজা বা শাসক তার প্রজাদের উপর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতেন এবং সমাজে সুশাসন বজায় রাখতেন। দণ্ডনীতি অনুযায়ী, অপরাধীদের শাস্তি প্রদান করা হত এবং সমাজে শাস্তির ভয় সৃষ্টি করে অপরাধ প্রবণতা হ্রাস করার চেষ্টা করা হত।
২. প্রাচীন ভারতের দণ্ডনীতির প্রকারভেদ:
প্রাচীন ভারতে দণ্ডনীতির বিভিন্ন প্রকারভেদ ছিল। মনুসংহিতা, অর্থশাস্ত্র এবং ধর্মশাস্ত্রে বিভিন্ন ধরণের দণ্ডনীতির উল্লেখ পাওয়া যায়। • মনুসংহিতা: মনুসংহিতা ছিল প্রাচীন ভারতের অন্যতম প্রধান আইনগ্রন্থ। এতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জন্য বিভিন্ন ধরনের শাস্তির বিধান ছিল। অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি নির্ধারিত হত এবং এর মাধ্যমে সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখা হত। • অর্থশাস্ত্র: অর্থশাস্ত্রের রচয়িতা চাণক্য বা কৌটিল্য। এটি একটি রাষ্ট্রনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ক গ্রন্থ। চাণক্য দণ্ডনীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন দিক আলোচনা করেছেন। তিনি রাজ্যের নিরাপত্তা, গুপ্তচরবৃত্তি, এবং বিচারব্যবস্থার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। • ধর্মশাস্ত্র: ধর্মশাস্ত্রেও দণ্ডনীতির বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়েছে। এতে ধর্ম এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে শাস্তি নির্ধারণের বিধান ছিল।
৩. দণ্ডনীতির মূল উপাদান:
দণ্ডনীতির মূল উপাদানগুলির মধ্যে ছিল যথোপযুক্ত বিচার, শাস্তি প্রদান, এবং অপরাধ প্রতিরোধ। • যথোপযুক্ত বিচার: দণ্ডনীতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যথোপযুক্ত বিচার করা। অপরাধের প্রকৃতি ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে শাস্তি প্রদান করা হত। • শাস্তি প্রদান: অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি নির্ধারণ করা হত। শাস্তির মাধ্যমে অপরাধীদের শুধরানো এবং ভবিষ্যতে অপরাধ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করা হত। • অপরাধ প্রতিরোধ: শাস্তির ভয় সৃষ্টি করে অপরাধ প্রতিরোধ করা ছিল দণ্ডনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এর মাধ্যমে সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখা হত।
৪. দণ্ডনীতির প্রভাব:
প্রাচীন ভারতে দণ্ডনীতি সমাজে শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এর মাধ্যমে শাসকগণ তাদের প্রজাদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতেন এবং অপরাধ প্রবণতা হ্রাস করার চেষ্টা করতেন।
দণ্ডনীতির আরেকটি প্রভাব ছিল এটি সমাজে শাস্তির ভয় সৃষ্টি করে অপরাধ প্রতিরোধ করতে সক্ষম ছিল। অপরাধীরা শাস্তির ভয়ে অপরাধ করতে নিরুৎসাহিত হত এবং সমাজে একটি সুশাসনের পরিবেশ সৃষ্টি হত।
UNIT-2 • রাজধর্মের বিশদ বিবরণ সহ মহাভারতের শান্তিপর্ব।
Ans:মহাভারত একটি বিশাল মহাকাব্য, যা ভারতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই মহাকাব্যের বিভিন্ন পার্বে বিভিন্ন ধরনের নীতিবাক্য ও জীবন দর্শন বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে শান্তিপর্ব একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে রাজধর্ম বা রাজধর্মের নীতির উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। শান্তিপর্বে বর্ণিত রাজধর্মের মূলনীতিগুলি বিভিন্ন দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়ের প্রেক্ষিতে তা আজও প্রাসঙ্গিক।
রাজধর্মের মূলনীতি:
শান্তিপর্বে বর্ণিত রাজধর্মে একটি ন্যায়বিচারমূলক শাসন ব্যবস্থার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। রাজাকে কেবলমাত্র ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে নয়, বরং জনগণের সেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এখানে বলা হয়েছে যে, রাজা জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল হতে হবে এবং তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে। রাজধর্মে উল্লেখিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হল:
1.ন্যায়বিচার: শান্তিপর্বে রাজধর্মে ন্যায়বিচারের গুরুত্ব অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা হয়েছে। রাজাকে এমনভাবে শাসন করতে হবে যাতে প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতি সমান ন্যায়বিচার করা হয়। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ সুবিধা বা বঞ্চনা করা উচিত নয়।
2.জনসেবক: রাজাকে জনগণের সেবক হিসেবে তার ভূমিকা পালন করতে হবে। তার কার্যকলাপের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জনগণের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা। তাকে সৎ ও নিরপেক্ষ হতে হবে এবং সর্বদা জনগণের মঙ্গল চিন্তা করতে হবে।
3.ধর্ম ও নীতির প্রতি আনুগত্য: রাজাকে সর্বদা ধর্ম ও নীতির প্রতি আনুগত্য পালন করতে হবে। তাকে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ বা ক্ষমতার লোভে কোন অন্যায় কাজ করা উচিত নয়।
4. ক্ষমার গুণ: রাজধর্মে ক্ষমার গুণকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রাজাকে ক্ষমাশীল হতে হবে এবং অযথা কঠোরতা বা প্রতিহিংসার পথ অনুসরণ করা উচিত নয়।
5.পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত: রাজাকে সর্বদা জ্ঞানী ও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ গ্রহণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এককভাবে কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত নয়।
6.অহিংসা ও শান্তি: রাজাকে সর্বদা অহিংসা ও শান্তির পথে চলতে হবে। যুদ্ধ ও হিংসার পথ ত্যাগ করে সর্বদা শান্তিপূর্ণ ও সমাধানমুখী নীতি গ্রহণ করতে হবে।
শান্তিপর্বের প্রাসঙ্গিকতা:
মহাভারতের শান্তিপর্বে বর্ণিত রাজধর্মের নীতি আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বর্তমান সমাজে যেখানে নানাবিধ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা বিদ্যমান, সেখানে এই নীতিগুলি অনুসরণ করে একটি ন্যায়বিচারমূলক ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠন করা সম্ভব। রাজা বা নেতার কর্তব্য হচ্ছে তার জনগণের সেবা করা এবং তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করা। একটি সুশাসিত রাষ্ট্রে যেখানে জনগণের প্রতি ন্যায়বিচার করা হয়, সেখানে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত হয়।
উপসংহার:
মহাভারতের শান্তিপর্বে বর্ণিত রাজধর্মের নীতিগুলি কেবলমাত্র প্রাচীন ভারতীয় সমাজের জন্য নয়, বরং বর্তমান সমাজের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নীতিগুলি অনুসরণ করে আমরা একটি ন্যায়বিচারমূলক, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠন করতে পারি। রাজধর্মের মূল শিক্ষা হল, রাজাকে জনগণের সেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং সর্বদা ন্যায়বিচার, ধর্ম ও নীতির প্রতি আনুগত্য রাখতে হবে। শান্তিপর্বের এই মূল্যবান শিক্ষা আমাদের সমাজকে আরও উন্নত ও সমৃদ্ধ করতে সহায়ক হবে।
****7) প্রশ্ন.বৌদ্ধ রাজনৈতিক চিন্তায় বর্ণিত রাজপদ সংক্রান্ত ধারনার মূল্যায়ণ কর। ১০
বৌদ্ধ রাজনৈতিক চিন্তায় বর্ণিত রাজপদ সংক্রান্ত ধারনার মূল্যায়ণ:
বৌদ্ধ ধর্ম এবং বৌদ্ধ রাজনৈতিক চিন্তা প্রাচীন ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম বুদ্ধের জীবন এবং শিক্ষা প্রচলিত সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় কাঠামোকে প্রভাবিত করেছে। বৌদ্ধ রাজনৈতিক চিন্তায় রাজপদ বা রাজ্যের শাসন সংক্রান্ত ধারনাগুলি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বুদ্ধের সময়ের শাসন পদ্ধতির বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে বৌদ্ধ রাজনৈতিক চিন্তা রাজ্যের শাসনের আদর্শ এবং নৈতিকতা সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।
রাজপদ সংক্রান্ত ধারনার মূলনীতি:
বৌদ্ধ ধর্মের মূলনীতি অনুসারে, রাজ্য বা রাজপদ একটি নৈতিক এবং ন্যায়সঙ্গত শাসনের প্রতীক হওয়া উচিত। বুদ্ধের উপদেশ অনুসারে, রাজ্যের শাসককে রাজধর্ম পালন করতে হবে, যা সাধারণ জনগণের কল্যাণ এবং সুখ নিশ্চিত করে। বুদ্ধের শিক্ষা অনুসারে, একজন শাসককে পাঁচটি মূল গুণাবলী পালন করতে হবে: 1. দান: রাজ্যের সম্পদ সুষ্ঠু বন্টনের মাধ্যমে জনগণের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করতে হবে। 2. শীল: নৈতিক চরিত্র এবং শুদ্ধ জীবনযাপন বজায় রাখতে হবে। 3. পারিসুদ্ধি: সিদ্ধান্ত গ্রহণে শুদ্ধতা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
4. সংজ্ঞা: জ্ঞান এবং বুদ্ধির মাধ্যমে রাজ্যের সুষ্ঠু পরিচালনা করতে হবে। 5. বিদ্যা: শিক্ষার প্রসার এবং জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে হবে।
বুদ্ধের সময়ের শাসন পদ্ধতি:
বুদ্ধের সময়ে রাজ্যের শাসন পদ্ধতি ছিল মূলত রাজতান্ত্রিক। তবে, বুদ্ধের শিক্ষা রাজতন্ত্রের পরিপন্থী ছিল না বরং রাজতন্ত্রকে একটি ন্যায়পরায়ণ এবং জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করার উপর জোর দিয়েছিল। বুদ্ধের মতে, একজন শাসক যদি তার প্রজাদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে, তবে সে একজন প্রকৃত রাজা। বুদ্ধের শিক্ষা অনুসারে, রাজ্য শাসনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণের সুখ এবং শান্তি নিশ্চিত করা।
রাজা অশোকের শাসন:
বৌদ্ধ রাজনৈতিক চিন্তার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ হলেন রাজা অশোক। অশোক মউর্য রাজবংশের একজন প্রতাপশালী শাসক ছিলেন, যিনি বুদ্ধের শিক্ষা গ্রহণ করে তার রাজত্বের শাসন পদ্ধতিতে প্রয়োগ করেছিলেন। কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন এবং রাজ্যের শাসনে বুদ্ধের নীতি অনুসরণ করেন। তিনি দান, শীল, পারিসুদ্ধি, সংজ্ঞা এবং বিদ্যার মূলনীতিগুলি তার রাজত্বে প্রয়োগ করেন এবং জনগণের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন। অশোকের শাসনকালে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটে এবং রাজ্যের শাসন একটি নৈতিক এবং ন্যায়পরায়ণ ব্যবস্থায় পরিণত হয়।
রাজপদ সংক্রান্ত ধারনার মূল্যায়ণ:
বৌদ্ধ রাজনৈতিক চিন্তায় রাজপদ সংক্রান্ত ধারনাগুলি একটি নৈতিক এবং ন্যায়পরায়ণ শাসন প্রতিষ্ঠার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। বুদ্ধের শিক্ষা অনুসারে, রাজ্যের শাসককে জনকল্যাণে নিবেদিত থাকতে হবে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। রাজা অশোকের শাসন এই ধারনার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ, যেখানে বুদ্ধের শিক্ষা প্রয়োগ করে রাজ্য শাসনের একটি মডেল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
তবে, বৌদ্ধ রাজনৈতিক চিন্তার এই আদর্শগুলি সর্বদা বাস্তবায়িত হয়নি। প্রাচীন এবং মধ্যযুগের অনেক রাজা এবং শাসক এই নীতিগুলি উপেক্ষা করেছেন এবং তাদের রাজত্বে জনগণের কল্যাণের চেয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। এর ফলে, রাজ্যের শাসন প্রায়শই অন্যায় এবং অবিচারের শিকার হয়েছে।
উপসংহার:
বৌদ্ধ রাজনৈতিক চিন্তায় রাজপদ সংক্রান্ত ধারনাগুলি একটি নৈতিক এবং ন্যায়পরায়ণ শাসন প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্বারোপ করে। বুদ্ধের শিক্ষা অনুসারে, রাজ্যের শাসককে জনকল্যাণে নিবেদিত থাকতে হবে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। যদিও এই আদর্শগুলি সর্বদা বাস্তবায়িত হয়নি, তবুও রাজা অশোকের শাসন একটি সফল উদাহরণ হিসাবে বিবেচিত হয়, যা বৌদ্ধ রাজনৈতিক চিন্তার গুরুত্ব এবং প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করে। বর্তমান সময়েও এই নীতিগুলি একটি ন্যায়পরায়ণ এবং কল্যাণমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠায় প্রাসঙ্গিক।
UNIT-3 • বৌদ্ধ রাজনৈতিক চিন্তা
****8) প্রশ্ন.বৌদ্ধ রাজনৈতিক চিন্তায় 'দীঘা নিকায়ার' সারবস্তু উল্লেখ কর। ১০
বৌদ্ধ রাজনৈতিক চিন্তায় 'দীঘা নিকায়ার' সারবস্তু:
'দীঘা নিকায়া' বৌদ্ধধর্মের পালি ক্যানোনিক্যাল গ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি মূলত সন্ন্যাসী ও গৃহস্থদের জন্য বিধান এবং ধর্মীয় উপদেশ প্রদান করে। তবে এর মধ্যে রাজনীতি সম্পর্কিত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাধারাও পাওয়া যায়। বৌদ্ধ রাজনৈতিক চিন্তা এবং 'দীঘা নিকায়ার' মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলির মধ্যে রয়েছে নৈতিকতা, শাসনের পদ্ধতি এবং সামাজিক কল্যাণ।
নৈতিকতা ও শাসন:
'দীঘা নিকায়া'য় নৈতিকতার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। রাজা বা শাসকের জন্য নৈতিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাদের সিদ্ধান্ত এবং কার্যক্রম সারা সমাজের উপর প্রভাব ফেলে। 'দীঘা নিকায়া' অনুসারে, একজন শাসককে সবসময় নৈতিক এবং ধর্মীয় আদর্শের প্রতি অবিচল থাকতে হবে। শাসকের উচিত প্রজাদের প্রতি দয়া ও করুণা প্রদর্শন করা এবং সর্বদা সত্যনিষ্ঠ থাকা।
দশরাজ ধর্ম:
'দীঘা নিকায়া'য় রাজাদের জন্য 'দশরাজ ধর্ম' নামে পরিচিত দশটি নীতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই নীতিগুলি রাজা বা শাসকের আদর্শ ও আচরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা হিসাবে কাজ করে। দশরাজ ধর্মের প্রধান নীতিগুলি হল:
1. দান (দান করা): শাসকের উচিত নিজের সম্পদ প্রজাদের কল্যাণে দান করা। 2. শীল (নৈতিকতা): শাসকের উচিত নৈতিক আদর্শ মেনে চলা।
3. পরিচ্ছাগা (ত্যাগ): শাসকের উচিত ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করা। 4. অজাভা (সত্যনিষ্ঠা): শাসকের উচিত সবসময় সত্য বলা। 5. মদ্ধব (মৃদুভাব): শাসকের উচিত নম্র এবং সদয় থাকা। 6. তপ (তপস্যা): শাসকের উচিত কঠোর পরিশ্রম করা। 7. অকোধ (রাগহীনতা): শাসকের উচিত রাগ নিয়ন্ত্রণ করা। 8. অভিসচ্চ (অহিংসা): শাসকের উচিত অহিংসা পালন করা। 9. খন্তি (সহনশীলতা): শাসকের উচিত সহনশীল থাকা। 10. অবিশম্ভনা (স্থিরতা): শাসকের উচিত মনের স্থিরতা বজায় রাখা।
চক্রবর্তী রাজা:
'দীঘা নিকায়া'য় চক্রবর্তী রাজা বা চক্রবর্তী সম্রাটের ধারণা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। চক্রবর্তী রাজা হলেন এমন একজন আদর্শ রাজা, যিনি ন্যায়পরায়ণতা ও ধর্মের ভিত্তিতে শাসন করেন। তার শাসনকাল শান্তি, সমৃদ্ধি এবং সুখে পূর্ণ হয়। চক্রবর্তী রাজা কেবলমাত্র তার সাম্রাজ্যের বিস্তারেই মনোনিবেশ করেন না, বরং প্রজাদের কল্যাণ এবং সামাজিক শৃঙ্খলার প্রতিও গভীর মনোযোগ দেন।
শাসন পদ্ধতি:
'দীঘা নিকায়া'য় শাসন পদ্ধতির বিষয়েও বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। বুদ্ধের মতে, শাসকের উচিত শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে পরামর্শ ও সহযোগিতা গ্রহণ করা। এছাড়াও, শাসনের ক্ষেত্রে প্রজাদের মতামত ও প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। শাসন পদ্ধতি হতে হবে ন্যায়সঙ্গত এবং সর্বজনীন কল্যাণের উপর ভিত্তি করে।
সামাজিক কল্যাণ:
'দীঘা নিকায়া'য় সামাজিক কল্যাণের বিষয়েও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। একজন শাসকের মূল দায়িত্ব হল প্রজাদের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা। শাসকের উচিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। শাসকের উচিত প্রজাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কাজ করা এবং সমাজে সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা।
উপসংহার:
'দীঘা নিকায়া' বৌদ্ধ রাজনৈতিক চিন্তার একটি অন্যতম প্রধান উৎস। এতে রাজা বা শাসকের জন্য নৈতিকতা, শাসনের পদ্ধতি এবং সামাজিক কল্যাণের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। দশরাজ ধর্ম, চক্রবর্তী রাজা এবং শাসন পদ্ধতির মাধ্যমে বৌদ্ধ রাজনৈতিক চিন্তাধারার একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। 'দীঘা নিকায়া'য় বর্ণিত এই চিন্তাধারাগুলি আজও প্রাসঙ্গিক এবং সমসাময়িক রাজনৈতিক শাসনের ক্ষেত্রে একটি আদর্শ নির্দেশিকা হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।
***9) প্রশ্ন. বুদ্ধের মতে একজন আদর্শ রাজার গুণাবলী কি কি? ৫
বুদ্ধের মতে, একজন আদর্শ রাজার গুণাবলী হলো ন্যায়বিচার, করুণা, ত্যাগ, এবং সেবার মানসিকতা। বুদ্ধের শিক্ষায় রাজাদের জন্য আদর্শ গুণাবলীর একটি পরিপূর্ণ তালিকা পাওয়া যায়, যা প্রজাদের কল্যাণ ও সুখ নিশ্চিত করে। রাজা শুধুমাত্র একটি শাসক নয়, বরং একজন পথপ্রদর্শক এবং রক্ষক হিসেবেও কাজ করে। এখানে বুদ্ধের মতে একজন আদর্শ রাজার প্রধান গুণাবলী নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
১. ন্যায়বিচার:
বুদ্ধের মতে, একজন আদর্শ রাজার গুণাবলী হলো ন্যায়বিচার, করুণা, ত্যাগ, এবং সেবার মানসিকতা। বুদ্ধের শিক্ষায় রাজাদের জন্য আদর্শ গুণাবলীর একটি পরিপূর্ণ তালিকা পাওয়া যায়, যা প্রজাদের কল্যাণ ও সুখ নিশ্চিত করে। রাজা শুধুমাত্র একটি শাসক নয়, বরং একজন পথপ্রদর্শক এবং রক্ষক হিসেবেও কাজ করে। এখানে বুদ্ধের মতে একজন আদর্শ রাজার প্রধান গুণাবলী নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
২. করুণা:
করুণা একজন আদর্শ রাজার অন্যতম প্রধান গুণ। রাজা সবসময় প্রজাদের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবেন এবং তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকবেন। করুণাময় রাজা প্রজাদের কল্যাণে নিবেদিত থাকেন এবং তাদের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য কাজ করেন। বুদ্ধের মতে, করুণাময় রাজা সবসময় প্রজাদের কল্যাণে সচেষ্ট থাকেন এবং তাদের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করেন।
৩. ত্যাগ:
বুদ্ধের মতে, একজন আদর্শ রাজার মধ্যে ত্যাগের মানসিকতা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজা নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে প্রজাদের কল্যাণে কাজ করবেন। নিজের স্বার্থের চেয়ে প্রজাদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবেন। ত্যাগের মানসিকতা একজন রাজার মধ্যে নৈতিকতা ও আদর্শিকতার বিকাশ ঘটায় এবং প্রজাদের মধ্যে শ্রদ্ধার স্থান করে নেয়।
৪. সেবা:
একজন আদর্শ রাজার মধ্যে সেবার মানসিকতা থাকা আবশ্যক। রাজা সবসময় প্রজাদের সেবা করবেন এবং তাদের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবেন। সেবার মানসিকতা একজন রাজার মধ্যে দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যনিষ্ঠার বিকাশ ঘটায়। রাজা প্রজাদের সেবা করার মাধ্যমে তাদের জীবনের মান উন্নয়নে সহায়তা করেন এবং সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখেন।
৫. সততা:
সততা একজন আদর্শ রাজার অন্যতম প্রধান গুণ। রাজা সবসময় সততা বজায় রেখে প্রজাদের সঙ্গে আচরণ করবেন এবং তাদের প্রতি সদাচরণ করবেন। সততার মাধ্যমে রাজা প্রজাদের আস্থা অর্জন করেন এবং তাদের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা সৃষ্টি করেন। বুদ্ধের মতে, সততা একজন রাজার মধ্যে নৈতিকতা ও আদর্শিকতার বিকাশ ঘটায় এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে।
৬. সহনশীলতা:
সহনশীলতা একজন আদর্শ রাজার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ। রাজা সবসময় সহনশীলতা বজায় রেখে প্রজাদের সঙ্গে আচরণ করবেন এবং তাদের মতামত ও অনুভূতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন। সহনশীলতা একজন রাজার মধ্যে নৈতিকতা ও আদর্শিকতার বিকাশ ঘটায় এবং সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখে।
৭. দায়িত্ববোধ:
একজন আদর্শ রাজার মধ্যে দায়িত্ববোধ থাকা আবশ্যক। রাজা সবসময় প্রজাদের কল্যাণে সচেষ্ট থাকবেন এবং তাদের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবেন। দায়িত্ববোধ একজন রাজার মধ্যে নৈতিকতা ও আদর্শিকতার বিকাশ ঘটায় এবং প্রজাদের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টি করে।
৮. প্রজ্ঞা:
প্রজ্ঞা একজন আদর্শ রাজার অন্যতম প্রধান গুণ। রাজা সবসময় প্রজ্ঞার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন এবং প্রজাদের কল্যাণে কাজ করবেন। প্রজ্ঞার মাধ্যমে রাজা সমাজের সমস্যাগুলি সমাধান করতে সক্ষম হন এবং প্রজাদের মধ্যে সুখ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করেন।
উপসংহার:
বুদ্ধের মতে, একজন আদর্শ রাজার মধ্যে ন্যায়বিচার, করুণা, ত্যাগ, সেবা, সততা, সহনশীলতা, দায়িত্ববোধ, এবং প্রজ্ঞা থাকা আবশ্যক। এই গুণাবলী রাজাকে প্রজাদের প্রতি দায়িত্বশীল ও আদর্শিক করে তোলে এবং সমাজে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে। রাজা যদি এই গুণাবলী ধারণ করেন, তবে তিনি প্রকৃতপক্ষে একজন আদর্শ রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন এবং প্রজাদের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবেন।
UNIT-4 • কৌটিল্যের রাজনৈতিক চিন্তা
****10) প্রশ্ন.পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনায় কূটনীতি সম্পর্কে কৌটিল্যের মত বিশ্লেষণ কর। ১০
কৌটিল্য, যিনি চানক্য নামেও পরিচিত, প্রাচীন ভারতের একজন খ্যাতিমান পণ্ডিত এবং অর্থশাস্ত্র নামক গ্রন্থের রচয়িতা। এই গ্রন্থটি মূলত রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির উপর ভিত্তি করে রচিত, কিন্তু এর মধ্যে কূটনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কৌটিল্যের দৃষ্টিতে, পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনায় কূটনীতি একটি অপরিহার্য উপাদান এবং তা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও সুরক্ষা রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কৌটিল্যের কূটনীতির মূলনীতি:
কৌটিল্য কূটনীতিকে ছয়টি মূলনীতি বা 'শাডগুণ্য' হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, যা একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। এই ছয়টি মূলনীতি হলো:
1. সন্ধি (Alliance): শত্রু রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি বা সন্ধি করা। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল যেখানে রাষ্ট্র কূটনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে শত্রুর প্রভাব কমানোর চেষ্টা করে। 2. বিগ্রহ (Hostility): শত্রুর সাথে সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া। যখন সন্ধি করা সম্ভব হয় না, তখন সংঘর্ষে যাওয়া একটি উপায়। 3. আসন (Neutrality): তৃতীয় পক্ষের সাথে নিরপেক্ষ থাকা। কখনো কখনো নিরপেক্ষ থাকা রাষ্ট্রের স্বার্থে কার্যকর হতে পারে। 4. যান (Marching): শত্রুর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা। এটি এক প্রকার আক্রমণাত্মক কূটনীতি। 5. সংরক্ষণ (Asylum): যখন রাষ্ট্র দুর্বল হয় তখন নিরাপদ আশ্রয় নেওয়া। এটি একটি প্রতিরক্ষামূলক কৌশল। 6. দ্বৈভব (Duplicity): একই সময়ে দুটি কৌশল অবলম্বন করা। এটি অত্যন্ত কৌশলী একটি পন্থা যেখানে রাষ্ট্র নিজের সুবিধা অনুযায়ী কূটনৈতিক নীতি পরিবর্তন করে।
কূটনীতির প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব:
কৌটিল্যের মতে, কূটনীতি হল এমন একটি শিল্প যা রাজা বা রাষ্ট্রনায়কের জ্ঞান ও বিচক্ষণতার পরিচায়ক। একজন দক্ষ রাষ্ট্রনায়ককে সর্বদা শত্রু ও মিত্র রাষ্ট্রের গতিবিধি সম্পর্কে সজাগ থাকতে হয় এবং সেই অনুযায়ী নীতি প্রণয়ন করতে হয়। কৌটিল্য মনে করেন, পররাষ্ট্রনীতির মূল উদ্দেশ্য হল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং তা করতে হলে কূটনৈতিক কৌশল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কূটনীতির বিভিন্ন দিক:
1. প্রতারণামূলক কূটনীতি: কৌটিল্য প্রতারণামূলক কূটনীতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় কখনো কখনো প্রতারণামূলক কৌশল অবলম্বন করা প্রয়োজন।
2. মিত্রতা ও বৈরিতার মিশ্রণ: কৌটিল্য মিত্রতা ও বৈরিতার মধ্যে একটি সুসমন্বয় বজায় রাখার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, মিত্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং শত্রুর সাথে বৈরিতা বজায় রাখা কূটনীতির একটি অংশ। 3. গোপন তথ্য সংগ্রহ: কৌটিল্য কূটনীতির অংশ হিসেবে গোপন তথ্য সংগ্রহকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, শত্রুর শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে জানা থাকলে কূটনৈতিক নীতি প্রণয়ন সহজ হয়।
কৌটিল্যের কূটনীতি ও আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আধুনিক কূটনীতির সাথে কৌটিল্যের কূটনীতির তুলনা করলে দেখা যায়, অনেক নীতি ও কৌশল আজও প্রযোজ্য। বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও পররাষ্ট্রনীতিতে যেসব কৌশল ব্যবহৃত হয়, তার অনেকটাই কৌটিল্যের শাডগুণ্যের সাথে মিলে যায়। উদাহরণস্বরূপ, আন্তর্জাতিক চুক্তি, সামরিক জোট, নিরপেক্ষতা, এবং কৌশলী সমঝোতা ইত্যাদি কৌটিল্যের নীতির আধুনিক রূপ।
কৌটিল্যের কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের শেখায় যে, রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার জন্য কূটনীতির কৌশলগুলি সময়োপযোগী এবং বাস্তববাদী হতে হবে। রাষ্ট্রের নেতৃত্বকে সর্বদা শত্রু ও মিত্র রাষ্ট্রের গতিবিধি সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে এবং সেই অনুযায়ী কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
উপসংহার:
পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনায় কৌটিল্যের কূটনৈতিক মতামত আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তাঁর কৌশল ও নীতি গুলি রাষ্ট্র পরিচালনায় একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করে। কৌটিল্যের কূটনীতি রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য উপাদান, যা কালের পরিক্রমায় আজও আধুনিক বিশ্বে প্রতিফলিত হয়।
****11) প্রশ্ন.কৌটিল্যের রাষ্ট্র সম্পর্কিত 'সপ্তাঙ্গ' তত্ব ব্যাখ্যা কর। ১০
কৌটিল্য, যিনি চাণক্য নামেও পরিচিত, ভারতের প্রাচীন রাজনৈতিক দর্শনের একজন প্রধান রূপকার। তিনি তার 'অর্থশাস্ত্র' গ্রন্থে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নানা তত্ত্ব এবং নীতির কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে রাষ্ট্র সম্পর্কিত 'সপ্তাঙ্গ' তত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 'সপ্তাঙ্গ' তত্ব অনুযায়ী, একটি রাষ্ট্র সাতটি মূল উপাদানে গঠিত। এই তত্ত্বের মাধ্যমে কৌটিল্য একটি সুশাসিত রাষ্ট্রের মূল ভিত্তিগুলি ব্যাখ্যা করেছেন। নিচে এই তত্ত্বের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হলো:
১. স্বামী (রাজা):
কৌটিল্যের মতে, রাজা হলেন রাষ্ট্রের প্রাণকেন্দ্র। তিনি একজন দক্ষ, ন্যায়পরায়ণ এবং প্রজাদের প্রতি দায়িত্বশীল শাসক হওয়া উচিত। রাজা কেবল শাসন করেন না, তিনি প্রজাদের মঙ্গল ও কল্যাণের প্রতি সচেতন থাকেন। একজন আদর্শ রাজা নিজের স্বার্থকে নয়, রাষ্ট্রের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন। তিনি নিজেকে নীতির অনুসারী রাখেন এবং অন্যদের ন্যায়পরায়ণতার পথে চালিত করেন।
২. অমাত্য (মন্ত্রিপরিষদ):
মন্ত্রিপরিষদ বা অমাত্যগণ হলেন রাজার সহযোগী এবং পরামর্শদাতা। তারা প্রশাসনিক কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে সহায়তা করেন। একজন দক্ষ মন্ত্রিপরিষদ রাষ্ট্রের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে এবং শাসনকার্যকে সহজ করে তোলে। কৌটিল্যের মতে, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের জ্ঞানী, সৎ, এবং দক্ষ হওয়া আবশ্যক।
৩. জনপদ (প্রজা ও অঞ্চল):
জনপদ বা অঞ্চল রাষ্ট্রের ভৌগোলিক এলাকা এবং তার অধিবাসীদের নির্দেশ করে। জনপদ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কৌটিল্যের মতে, একটি সমৃদ্ধ জনপদ রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব এবং শক্তির প্রধান উপাদান। জনগণের কল্যাণ, সুশিক্ষা এবং উন্নয়ন রাষ্ট্রের কর্তব্য।
৪. দুর্গ (প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা):
দুর্গ বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। একটি শক্তিশালী দুর্গ বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শত্রুর আক্রমণ থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষা করে এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বজায় রাখে। কৌটিল্যের মতে, রাষ্ট্রকে সবসময় একটি শক্তিশালী এবং সুসজ্জিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বজায় রাখতে হবে।
৫. কোষ (রাজস্ব ও অর্থনীতি):
কোষ বা রাজস্ব ব্যবস্থা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি। একটি সমৃদ্ধ কোষাগার রাষ্ট্রের কার্যকারিতা এবং উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। কৌটিল্যের মতে, কর সংগ্রহ ন্যায়পরায়ণ এবং সুশৃঙ্খল হতে হবে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রাষ্ট্রের ক্ষমতা এবং প্রভাব বৃদ্ধি করে।
৬. দন্ড (আইন ও বিচার):
দন্ড বা বিচার ব্যবস্থা রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা এবং ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করে। আইন এবং বিচারব্যবস্থা রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি। কৌটিল্যের মতে, একটি ন্যায়পরায়ণ এবং শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব এবং সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করে। অপরাধ দমন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য।
৭. মিত্র (বন্ধুরাষ্ট্র)):
মিত্র বা বন্ধুরাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং কূটনীতি পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি শক্তিশালী মিত্ররাষ্ট্র নেটওয়ার্ক রাষ্ট্রের সুরক্ষা এবং কূটনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করে। কৌটিল্যের মতে, মিত্র রাষ্ট্রগুলির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং তাদের থেকে সমর্থন আদায় করা রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার:
কৌটিল্যের 'সপ্তাঙ্গ' তত্ব প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং রাজনীতির একটি মৌলিক দিক। এই তত্ত্বের মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রের বিভিন্ন উপাদানের গুরুত্ব এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেছেন। একটি সুশাসিত এবং শক্তিশালী রাষ্ট্রের জন্য এই সাতটি উপাদান একসঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রতিটি উপাদান একে অপরের পরিপূরক এবং একটি রাষ্ট্রের সাফল্য তাদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভর করে। কৌটিল্যের এই তত্ত্ব আজও রাজনীতিবিদ, প্রশাসক এবং নীতিনির্ধারকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা হিসাবে বিবেচিত হয়।
****12) প্রশ্ন.কৌটিল্য রাষ্ট্রকে প্রজাকল্যাণকামী রাষ্ট্রে কি পরিণত করতে পেরেছিলেন? তোমার উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তি দাও। ৫
কৌটিল্য, যিনি চাণক্য বা বিষ্ণুগুপ্ত নামেও পরিচিত, ছিলেন প্রাচীন ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও অর্থশাস্ত্রের রচয়িতা। তার রচিত গ্রন্থ 'অর্থশাস্ত্র' রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামরিক কৌশল নিয়ে ব্যাপক জ্ঞানবহুল আলোচনা করে। এই গ্রন্থে তিনি রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য হিসেবে প্রজাকল্যাণকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
প্রজাকল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে কৌটিল্যের অবদান নিয়ে আলোচনা করার পূর্বে আমাদের বুঝতে হবে যে, কৌটিল্য কিভাবে প্রজাকল্যাণের ধারণাকে রাষ্ট্রের মূলনীতিতে রূপান্তরিত করেছিলেন।
১. অর্থনৈতিক নীতি:
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে অর্থনৈতিক উন্নতির উপর জোর দেওয়া হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একটি সমৃদ্ধ অর্থনীতি রাষ্ট্রের ভিত্তি। কৌটিল্য রাজস্ব সংগ্রহের নীতিতে তর্ক-বিতর্ক করে প্রজাদের উপর করের বোঝা কমানোর সুপারিশ করেছিলেন। তিনি কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ইত্যাদির উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করার পরিকল্পনা করেছিলেন। তার মতে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে যেন প্রজারা সুখী ও সচ্ছল হতে পারে।
২. সামাজিক নীতি:
কৌটিল্য রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচারের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি সামাজিক স্তরের উন্নয়ন ও সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের উন্নতির জন্য কাজ করেছেন। নারীর অবস্থান ও অধিকার সম্পর্কে তার চিন্তাধারা আধুনিক যুগের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রগতিশীল ছিল। তিনি নারী শিক্ষা ও স্বনির্ভরতার পক্ষে ছিলেন এবং নারীদের প্রতি সামাজিক ন্যায়বিচার প্রদানের উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
৩. আইন ও শাসন:
কৌটিল্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে ছিলেন। তার মতে, আইনের শাসন না থাকলে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অবিচার ছড়িয়ে পড়বে। কৌটিল্য প্রজাদের অধিকার রক্ষা এবং অপরাধ দমন করার জন্য কঠোর আইন প্রণয়নের পক্ষে ছিলেন। তিনি একটি শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা গঠনের কথা বলেছেন যেখানে অপরাধীরা শাস্তি পাবে এবং নিরপরাধীরা ন্যায়বিচার পাবে।
৪. সামরিক নীতি:
কৌটিল্য রাষ্ট্রের সুরক্ষা ও স্থিতিশীলতার উপর জোর দিয়েছেন। তার মতে, একটি নিরাপদ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রজাদের নিরাপত্তা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে পারে। তিনি একটি শক্তিশালী ও দক্ষ সেনাবাহিনী গঠনের পক্ষে ছিলেন যা রাষ্ট্রকে বাহ্যিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে।
৫. শিক্ষা ও সংস্কৃতি:
কৌটিল্য শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং রাষ্ট্রের প্রজাদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটানোর উপর জোর দিয়েছিলেন। তার মতে, শিক্ষা মানুষের চিন্তা-চেতনার উন্নতি ঘটায় এবং সমাজকে উন্নতির পথে নিয়ে যায়। তিনি সংস্কৃতি ও ধর্মের ক্ষেত্রে সহনশীলতার পক্ষে ছিলেন যা সমাজে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সহায়ক।
৬. আর্থ-সামাজিক সংস্কার:
কৌটিল্য বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে প্রজাদের জীবনের মানোন্নয়নের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তিনি কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন, সেচ ব্যবস্থা উন্নতি, বাণিজ্য ও শিল্পের প্রসার, শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের কল্যাণে কাজ করেছিলেন।
উপসংহার:
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কৌটিল্য তার নীতিসমূহের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে প্রজাকল্যাণকামী রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করেছিলেন। তার রচিত অর্থশাস্ত্র প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চেতনার একটি মাইলফলক হয়ে আছে। যদিও কৌটিল্যের নীতিসমূহ সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়েছিল কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তবু তার চিন্তাধারা ও নীতিগুলি প্রজাদের কল্যাণে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কৌটিল্যের নীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি সুখী, সচ্ছল ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন করা, যা আজকের যুগেও প্রাসঙ্গিক।
UNIT-5 • ভারতে মধ্যযুগীয় রাজনৈতিক চিন্তাধারা
****13) প্রশ্ন.ভারতের মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর। ১০
ভারতের মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রচিন্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যা ভারতীয় ইতিহাস ও রাজনীতির বৃত্তান্তে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে। মধ্যযুগীয় ভারতে রাষ্ট্রচিন্তার বিবর্তন ও বৈশিষ্ট্যগুলি প্রাচীন ভারতীয় সমাজের পরিবর্তিত অবস্থার প্রতিফলন। এখানে মধ্যযুগীয় ভারতের রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা হলো।
১. ধর্মের প্রভাব:
মধ্যযুগীয় ভারতের রাষ্ট্রচিন্তায় ধর্ম একটি প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। এই সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মীয় নীতি ও আদর্শগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। হিন্দু ধর্মের শাস্ত্র এবং ইসলাম ধর্মের কোরআন ও হাদিস রাষ্ট্র পরিচালনার মুল্যবান উৎস ছিল। শাসকরা ধর্মীয় নেতাদের পরামর্শ মেনে চলতেন এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলি পালন করতেন।
২. রাজশক্তি ও রাজধর্ম:
মধ্যযুগীয় ভারতে রাজধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ছিল। রাজা ছিলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি এবং তাঁর শাসনকে ধর্মীয় ও নৈতিকভাবে বৈধ করা হতো। রাজধর্ম অনুযায়ী, রাজা ছিলেন প্রজাদের রক্ষক ও সেবক। রাজা প্রজাদের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য দায়িত্বশীল ছিলেন এবং তাঁদের প্রতি ন্যায় ও নৈতিকতার ভিত্তিতে শাসন করতেন।
৩. সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা:
মধ্যযুগীয় ভারতের রাষ্ট্রচিন্তায় সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজ্যগুলো ছোট ছোট সামন্তরাজ্যে বিভক্ত ছিল, এবং প্রতিটি সামন্তরাজ্যের নিজস্ব শাসক ছিল। প্রধান রাজা বা সম্রাটের অধীনে এই সামন্তরাজ্যগুলো স্বশাসিত ছিল এবং প্রধান রাজার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করত।
৪. প্রজাস্বার্থের গুরুত্ব:
মধ্যযুগীয় ভারতের রাষ্ট্রচিন্তায় প্রজাস্বার্থ ও প্রজাদের কল্যাণের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো। রাজা ও শাসকদের প্রধান দায়িত্ব ছিল প্রজাদের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রের সকল কার্যক্রম প্রজাদের কল্যাণের জন্য পরিচালিত হতো এবং প্রজারা শাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন।
৫. ন্যায় ও বিচারব্যবস্থা:
মধ্যযুগীয় ভারতে ন্যায় ও বিচারব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল। রাজা ও শাসকরা ন্যায় ও বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন আইন ও শাস্ত্র প্রণয়ন করতেন। বিচারব্যবস্থা ছিল কঠোর ও নিয়মবদ্ধ, এবং অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হতো। রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারক এবং তাঁর বিচার সর্বজনীন ও চূড়ান্ত ছিল।
৬. সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস:
মধ্যযুগীয় ভারতের রাষ্ট্রচিন্তায় সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল। সমাজ বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল, যেমন রাজা, রাজন্যবর্গ, যোদ্ধা, কৃষক, কারিগর ইত্যাদি। প্রতিটি শ্রেণির নিজস্ব ভূমিকা ও দায়িত্ব ছিল এবং সমাজে তাদের নির্দিষ্ট স্থান ও মর্যাদা ছিল।
৭. সামরিক শক্তির গুরুত্ব:
মধ্যযুগীয় ভারতের রাষ্ট্রচিন্তায় সামরিক শক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল। শাসকরা তাঁদের সাম্রাজ্য রক্ষা ও সম্প্রসারণের জন্য শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গড়ে তুলতেন। যুদ্ধবিগ্রহ ও বিজয় অভিযানে সামরিক শক্তি একটি প্রধান উপাদান ছিল এবং শাসকদের ক্ষমতা ও প্রতPrestige নির্ধারিত হতো তাঁদের সামরিক কৃতিত্বের উপর।
৮. সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মেলবন্ধন:
মধ্যযুগীয় ভারতের রাষ্ট্রচিন্তায় সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মেলবন্ধন একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল। এই সময়ে ভারত বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মিলনস্থল ছিল। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, এবং ইসলাম ধর্মের মেলবন্ধনে একটি বহুমুখী সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। এই মেলবন্ধনের ফলে সমাজে একটি বহুত্ববাদী ও সহিষ্ণু মনোভাব বিকাশ লাভ করেছিল।
৯. অর্থনৈতিক ব্যবস্থা:
মধ্যযুগীয় ভারতের রাষ্ট্রচিন্তায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কৃষি ছিল অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি, এবং শাসকরা কৃষির উন্নতি ও কৃষকদের কল্যাণে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। কর ও শুল্ক সংগ্রহ ছিল রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস এবং এই রাজস্ব রাজ্য পরিচালনা ও সামরিক ব্যয়ের জন্য ব্যবহার করা হতো।
১০. শিক্ষা ও সাহিত্য:
মধ্যযুগীয় ভারতের রাষ্ট্রচিন্তায় শিক্ষা ও সাহিত্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল। শাসকরা শিক্ষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গ্রন্থাগার স্থাপন করতেন। সংস্কৃত, পারসিয়ান, আরবি ও অন্যান্য ভাষায় সাহিত্যিক কর্মকাণ্ড ছিল সমৃদ্ধ।
উপসংহার:
ভারতের মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রচিন্তা একটি বিস্তৃত ও বহুমুখী বিষয় যা বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপাদানগুলির সমন্বয়ে গঠিত। এই সময়ে রাষ্ট্রচিন্তার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি ধর্ম, রাজধর্ম, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা, প্রজাস্বার্থ, ন্যায় ও বিচারব্যবস্থা, সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস, সামরিক শক্তি, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মেলবন্ধন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, এবং শিক্ষা ও সাহিত্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। মধ্যযুগীয় ভারতের রাষ্ট্রচিন্তা একটি সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় অধ্যায় যা ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে।
****14) প্রশ্ন.বারানি নির্দেশিত আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সুলতানের গুণাবলী বিষয়ে একটি টীকা লেখ। ৫
মধ্যযুগীয় ভারতীয় ইতিহাসে বারানি একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক ছিলেন। তিনি দিল্লির সুলতানদের শাসনকালের একটি বিশদ বিবরণ দিয়েছেন এবং তার রচনায় রাষ্ট্রব্যবস্থা ও শাসনের আদর্শ গুণাবলীর প্রতি আলোকপাত করেছেন। বারানি তার বিখ্যাত গ্রন্থ "তারিখ-ই-ফিরোজশাহি"তে সুলতানের গুণাবলী সম্পর্কে বিশেষ জোর দিয়েছেন। তার দৃষ্টিতে আদর্শ সুলতান কেমন হওয়া উচিত, তা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। এই টীকায় বারানির দৃষ্টিকোণে আদর্শ সুলতানের গুণাবলীর উপর আলোচনা করা হবে।
নৈতিকতা ও ধর্মীয়তা:
বারানির মতে, একজন আদর্শ সুলতানের প্রথম এবং প্রধান গুণ হল তার নৈতিকতা ও ধর্মীয়তা। সুলতানকে অবশ্যই ধর্মীয় শিক্ষায় জ্ঞানী হতে হবে এবং ইসলামের প্রতি অনুগত থাকতে হবে। তার মতে, সুলতান যদি ধর্মনিষ্ঠ এবং নৈতিক হয়, তবে তার শাসনকালে প্রজা নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে। ধর্মীয় নীতিমালা মেনে চলা সুলতানের জন্য অপরিহার্য, কারণ এটি শাসনের ন্যায্যতা এবং প্রজাদের প্রতি দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করে।
ন্যায়পরায়ণতা:
বারানি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন সুলতানের ন্যায়পরায়ণতার উপর। তিনি মনে করেন, একজন সুলতানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ হল ন্যায়পরায়ণতা। সুলতানকে তার প্রজাদের প্রতি সুবিচার করতে হবে এবং কোনোরকম অবিচার বা অন্যায় করা উচিত নয়। বারানির মতে, ন্যায়পরায়ণতা একটি শাসকের প্রধান ধর্ম, যা তাকে প্রজাদের নিকট বিশ্বাসযোগ্য এবং সম্মানিত করে তোলে।
জ্ঞান ও প্রজ্ঞা:
বারানি মনে করেন যে একজন আদর্শ সুলতানের জ্ঞানী এবং প্রজ্ঞাবান হওয়া উচিত। সুলতানের জ্ঞানের পরিধি শুধু ধর্মীয় বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়, বরং রাষ্ট্র পরিচালনা, অর্থনীতি, সামরিক কৌশল, এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্পর্কেও তার গভীর জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। একজন সুলতানকে শুধু শাসকই নয়, বরং একজন শিক্ষিত ও প্রাজ্ঞ নেতা হতে হবে, যিনি তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও প্রগতির পথে পরিচালিত করবেন।
সাহস ও দৃঢ়তা:
সুলতানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ হল সাহস ও দৃঢ়তা। বারানি মনে করেন, একজন সুলতানকে যুদ্ধে এবং শাসনে সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। তার শাসনকালে যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করতে হবে এবং দৃঢ়চিত্তে রাষ্ট্রের সুরক্ষা ও শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। সুলতানের সাহসিকতা ও দৃঢ়তা তার শাসনকে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল করে।
সহমর্মিতা ও দানশীলতা:
বারানি উল্লেখ করেছেন যে একজন সুলতানের সহমর্মিতা ও দানশীলতা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুলতানকে তার প্রজাদের কষ্ট ও সমস্যার প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে এবং তাদের কল্যাণের জন্য কাজ করতে হবে। সুলতানকে দরিদ্র ও অসহায় প্রজাদের প্রতি দানশীল হতে হবে এবং তাদের সহায়তায় সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। এর ফলে সুলতানের প্রতি প্রজাদের বিশ্বাস ও আনুগত্য বৃদ্ধি পায়।
ধৈর্য ও সহনশীলতা:
ধৈর্য ও সহনশীলতা সুলতানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ। বারানি মনে করেন, একজন সুলতানকে সর্বদা ধৈর্যশীল ও সহনশীল হতে হবে। শাসনকালে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সুলতানের ধৈর্য ও সহনশীলতা তাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে এবং রাষ্ট্রের শান্তি ও স্থিতি বজায় রাখে।
পরিশেষে:
বারানির দৃষ্টিতে আদর্শ সুলতানকে শুধু একজন শাসক হিসেবেই নয়, বরং একজন ধর্মপ্রাণ, ন্যায়পরায়ণ, জ্ঞানী, সাহসী, সহমর্মী, এবং ধৈর্যশীল নেতা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। এসব গুণাবলী সমন্বিত থাকলে একজন সুলতান তার শাসনকে স্থিতিশীল ও সফল করতে সক্ষম হন। বারানির এই আদর্শ সুলতানের ধারণা তার সময়ের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ছিল এবং তা আজও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়।
****15) প্রশ্ন.ভারতের মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রচিন্তায় সমন্বয়বাদী আদর্শের উপর একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ। ৫
ভারতের মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রচিন্তায় সমন্বয়বাদী আদর্শ:
ভারতের মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রচিন্তায় সমন্বয়বাদী আদর্শ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই সময়কালে ভারতীয় সমাজে বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি এবং সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে মিলন ও মৈত্রী স্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছিল। মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রচিন্তায় সমন্বয়বাদী আদর্শ প্রধানত ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে প্রকাশ পেয়েছিল।
ধর্মীয় সমন্বয়বাদ:
মধ্যযুগে ভারতের ধর্মীয় সমন্বয়বাদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বিভিন্ন ধর্মীয় নেতা এবং সাধকরা। সুফি সাধক, ভক্তি আন্দোলনের সাধক এবং হিন্দু-মুসলিম পণ্ডিতেরা ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন। এই সময়ে সুফি ও ভক্তি আন্দোলনের মিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল এক নতুন ধর্মীয় সংস্কৃতি। হিন্দু-মুসলিম সাধকরা একে অপরের ধর্মীয় আচার ও বিশ্বাসকে সম্মান দেখিয়ে চলতেন। এর ফলে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহাবস্থানের এক সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল।
রাজনৈতিক সমন্বয়বাদ:
মধ্যযুগীয় ভারতের রাজনৈতিক সমন্বয়বাদে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন দিল্লি সুলতান এবং মুঘল সম্রাটরা। এই সময়কালে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষকে একত্রিত করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল। মুঘল সম্রাট আকবর এই সমন্বয়বাদের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তিনি ‘দীন-ই-ইলাহী’ নামে একটি নতুন ধর্ম প্রচলন করেন, যা বিভিন্ন ধর্মের সেরা শিক্ষাগুলি গ্রহণ করে গঠিত হয়েছিল। আকবরের শাসনামলে হিন্দু ও মুসলিম উভয়কেই উচ্চ পদে নিয়োগ করা হত এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার নীতিকে গুরুত্ব দেওয়া হত।
সামাজিক সমন্বয়বাদ:
সামাজিক ক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় ভারতের সমন্বয়বাদী আদর্শের মূল লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি ও সহাবস্থান নিশ্চিত করা। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে সকল ধর্মের মানুষকে একত্রিত করার প্রচেষ্টা চালানো হত। এর পাশাপাশি বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজ সংস্কৃতি, ভাষা ও শিল্পকলার মিশ্রণে নতুন নতুন সাংস্কৃতিক ধারা সৃষ্টি হয়েছিল।
সমন্বয়বাদী আদর্শের প্রভাব:
মধ্যযুগীয় ভারতের সমন্বয়বাদী আদর্শ শুধু রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এটি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সহাবস্থান ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেছিল। সমন্বয়বাদী আদর্শের ফলে সমাজে সামগ্রিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা বজায় ছিল এবং ভারত একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে পেরেছিল।
উপসংহার:
ভারতের মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রচিন্তায় সমন্বয়বাদী আদর্শ এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি সমাজের বিভিন্ন স্তরে মৈত্রী ও সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে সমন্বয়বাদের এই আদর্শ ভারতের সমাজকে আরও সুসংহত এবং সমৃদ্ধ করেছে। মধ্যযুগীয় ভারতের এই সমন্বয়বাদী চিন্তাধারা আধুনিক ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভিত্তি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
****16) প্রশ্ন. ভারতের মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রচিন্তায় বারাণির আদর্শ-রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কিত ধারনার প্রধান বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত দিকগুলি আলোচনা কর। ১০
ভারতের মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রচিন্তায় এক উল্লেখযোগ্য নাম হলো জিয়াউদ্দিন বারাণি। তিনি ছিলেন দিল্লি সালতানাতের সময়কার একজন গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক এবং চিন্তাবিদ। তার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ "তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী" এবং "ফতওয়া-ই-জাহান্দারি" মধ্যযুগীয় ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাজনীতি এবং সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে। বারাণির আদর্শ-রাষ্ট্রব্যবস্থা তার সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই আলোচনায় আমরা বারাণির আদর্শ-রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত দিকগুলি বিশদভাবে আলোচনা করবো।
১. ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক:
বারাণির আদর্শ-রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্ম এবং রাজনীতির মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্কের ধারণা বিদ্যমান। তিনি বিশ্বাস করতেন যে একজন শাসকের ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা উচিত এবং শাসনকার্যে ধর্মীয় নীতি ও মূল্যবোধ প্রয়োগ করা উচিত। বারাণির মতে, ধর্মই শাসকের নৈতিকতার ভিত্তি এবং ধর্মীয় নীতিই রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও শান্তির মূল উৎস।
২. ন্যায় ও নৈতিকতার গুরুত্ব:
বারাণির রাষ্ট্রচিন্তায় ন্যায় ও নৈতিকতার গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি মনে করতেন যে একজন আদর্শ শাসককে অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ হতে হবে এবং প্রজাদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। শাসকের নৈতিকতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা ও শান্তি বজায় রাখা সম্ভব।
৩. শক্তিশালী শাসক ও কেন্দ্রীয় শাসন:
বারাণির আদর্শ-রাষ্ট্রব্যবস্থায় শক্তিশালী শাসক ও কেন্দ্রীয় শাসনের গুরুত্ব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি মনে করতেন যে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির জন্য একজন শক্তিশালী শাসক প্রয়োজন, যিনি কেন্দ্র থেকে সমস্ত অঞ্চলের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সক্ষম হবেন। কেন্দ্রীয় শাসনের মাধ্যমে রাজ্য পরিচালনা ও সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব।
৪. প্রশাসনিক দক্ষতা:
বারাণি প্রশাসনিক দক্ষতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তার মতে, একজন আদর্শ শাসককে প্রশাসনিক কাজে দক্ষ হতে হবে এবং উপযুক্ত ও যোগ্য ব্যক্তিদের প্রশাসনের বিভিন্ন পদে নিয়োগ করতে হবে। প্রশাসনের দক্ষতা ও কার্যকরিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা যায়।
৫. কর ও অর্থনীতি:
বারাণির আদর্শ-রাষ্ট্রব্যবস্থায় কর ও অর্থনীতির গুরুত্বও উল্লেখযোগ্য। তিনি কর ব্যবস্থার সুষ্ঠু ও ন্যায়সঙ্গত পরিচালনার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রজাদের ওপর কর আরোপে ন্যায়বিচার ও সুষমতা নিশ্চিত করতে হবে এবং রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতি ও সুষ্ঠু পরিচালনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি অর্জন করা যায়।
৬. শিক্ষা ও সংস্কৃতি:
বারাণি শিক্ষার গুরুত্বকেও অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি মনে করতেন যে একজন আদর্শ শাসককে শিক্ষিত ও জ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে এবং শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে অবদান রাখতে হবে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রগতি ও সমৃদ্ধি সম্ভব।
৭. ধর্মীয় সহিষ্ণুতা:
বারাণির আদর্শ-রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্মীয় সহিষ্ণুতার গুরুত্বও উল্লেখযোগ্য। তিনি বিশ্বাস করতেন যে শাসককে সকল ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু হতে হবে এবং ধর্মীয় বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যকে সম্মান করতে হবে। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব।
৮. সামরিক শক্তি:
বারাণির আদর্শ-রাষ্ট্রব্যবস্থায় সামরিক শক্তির গুরুত্বও উল্লেখযোগ্য। তিনি মনে করতেন যে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য শক্তিশালী সামরিক বাহিনী অপরিহার্য। সামরিক শক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষা ও অভ্যন্তরীণ শান্তি বজায় রাখা যায়।
৯. সামাজিক সাম্য:
বারাণির রাষ্ট্রচিন্তায় সামাজিক সাম্যের ধারণাও বিদ্যমান। তিনি মনে করতেন যে সমাজে সকলের জন্য সমান সুযোগ ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং সামাজিক বৈষম্য দূর করতে হবে। সামাজিক সাম্যের মাধ্যমে রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা যায়।
উপসংহার:
জিয়াউদ্দিন বারাণির আদর্শ-রাষ্ট্রব্যবস্থা মধ্যযুগীয় ভারতের রাষ্ট্রচিন্তায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তার রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক, ন্যায় ও নৈতিকতা, শক্তিশালী শাসক ও কেন্দ্রীয় শাসন, প্রশাসনিক দক্ষতা, কর ও অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, সামরিক শক্তি এবং সামাজিক সাম্য। বারাণির আদর্শ-রাষ্ট্রব্যবস্থা মধ্যযুগীয় ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ছিল এবং তা বর্তমানকালেও রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
UNIT-6 • আবুল ফজল: শাসন ও প্রশাসন। কবীর: সমন্বয়বাদের ধারণা।
****17) প্রশ্ন. সূল-ই-কুল এর উপর একটি টীকা লেখ। ৫
ভূমিকা:
সূল-ই-কুল (Sulh-i-Kul) একটি পারস্য শব্দগুচ্ছ, যার অর্থ "সর্বজনীন শান্তি।" এটি একটি বিশেষ নীতি যা ১৬শ শতাব্দীতে মোঘল সম্রাট আকবর প্রবর্তন করেছিলেন। এই নীতির লক্ষ্য ছিল সমাজে সম্প্রীতি ও সাম্প্রদায়িক সমন্বয় সাধন করা। সূল-ই-কুল নীতি আকবরের শাসনামলে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল এবং তার সাম্রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে দাঁড়ায়।
সূল-ই-কুল এর প্রেক্ষাপট:
আকবরের সময় ভারতবর্ষে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ এবং সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস ছিল। বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত ও বৈষম্য ছিল এক সাধারণ ঘটনা। এই বৈচিত্র্যময় সমাজে স্থায়িত্ব ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আকবর বুঝতে পেরেছিলেন যে তার সাম্রাজ্যে শান্তি এবং স্থায়িত্ব আনতে হলে ধর্মীয় সহনশীলতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে তিনি সূল-ই-কুল নীতির প্রবর্তন করেন।
সূল-ই-কুল এর মূল ধারণা:
সূল-ই-কুল এর প্রধান ধারণা ছিল সমস্ত ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের প্রতি সমান সম্মান ও সহানুভূতি প্রদর্শন করা। এই নীতির মাধ্যমে আকবর সকল ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতি ও সহনশীলতা বৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সকল ধর্মই মূলত এক এবং সকলের উদ্দেশ্য একই, তা হলো মানবজাতির কল্যাণ।
আকবরের প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং সূল-ই-কুল:
আকবর তার প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সূল-ই-কুল নীতির প্রয়োগ করেন। তিনি সকল ধর্মের পণ্ডিত ও জ্ঞানীদের সম্মান করতেন এবং তাদের মতামত শুনতেন। তার দরবারে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, জৈন, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতিনিধিদের জন্য সমান সুযোগ প্রদান করা হতো।
আকবর দীন-ই-ইলাহি নামে একটি নতুন ধর্মীয় নীতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা সূল-ই-কুল নীতির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। দীন-ই-ইলাহি মূলত একটি ধর্মীয় নীতি ছিল যা বিভিন্ন ধর্মের মূলতত্ত্বগুলিকে একত্রিত করে একটি একক ধর্মীয় মতবাদ গঠনের প্রচেষ্টা ছিল।
সূল-ই-কুল এর প্রভাব:
সূল-ই-কুল নীতির ফলে আকবরের শাসনামলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পায়। তার শাসনামলে ধর্মীয় সংঘাত ও বৈষম্য অনেকটাই কমে যায় এবং সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। সূল-ই-কুল নীতির ফলে আকবরের সাম্রাজ্য একটি শক্তিশালী ও সুসংহত সাম্রাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
সূল-ই-কুল এর গুরুত্ব:
সূল-ই-কুল নীতির গুরুত্ব আজও অক্ষুণ্ণ। এই নীতি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহনশীলতার গুরুত্ব বোঝাতে সাহায্য করে। বর্তমান সময়েও, যখন বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত ও বিভাজন দেখা যায়, সূল-ই-কুল এর মত নীতির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এই নীতি আমাদেরকে শান্তি ও সম্প্রীতির পথে পরিচালিত করতে সাহায্য করে এবং একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে সহায়ক হয়।
উপসংহার:
সূল-ই-কুল নীতি আকবরের শাসনামলে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। এই নীতির মাধ্যমে আকবর তার সাম্রাজ্যে শান্তি ও স্থায়িত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। আজও এই নীতি আমাদের জন্য একটি মূল্যবান শিক্ষা হয়ে আছে, যা আমাদেরকে সম্প্রীতি ও সহনশীলতার পথে পরিচালিত করে। সূল-ই-কুল এর গুরুত্ব আমরা কখনই উপেক্ষা করতে পারি না, বরং এর মর্মার্থ বুঝে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর প্রয়োগ ঘটানো উচিত।
****18) প্রশ্ন. কবীরের অধ্যাত্মবাদী চিন্তার মূল কথা আলোচনা কর। ১০
ভূমিকা:
কবীর দাস, ভারতীয় মরমিয়া সাধকদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। তাঁর ভাবনা ও রচনায় তিনি সমকালীন সমাজের বিভিন্ন সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। কবীরের চিন্তাধারা মূলত আধ্যাত্মিকতা, মানবতা এবং ঈশ্বরের সাথে সরাসরি সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে গঠিত। তাঁর আধ্যাত্মবাদী চিন্তা সমকালীন সমাজে প্রভাব ফেলেছে এবং আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।
আধ্যাত্মবাদী চিন্তার ভিত্তি:
কবীরের আধ্যাত্মবাদী চিন্তার মূল ভিত্তি হল একেশ্বরবাদ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। তাঁর মতে, ঈশ্বর নিরাকার এবং সর্বত্র বিরাজমান। তিনি মূর্তিপূজা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং বাহ্যিক আড়ম্বরকে অস্বীকার করেছেন। কবীরের মতে, প্রকৃত ধর্ম হল মনকে পবিত্র রাখা এবং সৎ কর্ম করা।
মরমিয়া ধ্যান ও যোগ:
কবীরের আধ্যাত্মবাদী চিন্তায় ধ্যান ও যোগের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তিনি মনে করতেন যে যোগের মাধ্যমে মানুষ ঈশ্বরের সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। তাঁর মতে, ধ্যানের মাধ্যমে মনের অশান্তি দূর হয়ে আত্মার সাথে সংযোগ স্থাপিত হয়। তিনি বলেন, "সাহেব সে মিলবেকো, যোগ সাধনা কর।" অর্থাৎ, ঈশ্বরের সাথে মিলিত হতে হলে যোগ সাধনা করতে হবে।
মানবতাবাদ:
কবীরের আধ্যাত্মবাদী চিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল মানবতাবাদ। তিনি মানবতার মূল্যে বিশ্বাসী ছিলেন এবং মানুষের মধ্যে বিভেদ, হিংসা, বিদ্বেষ দূর করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর মতে, সব মানুষই ঈশ্বরের সৃষ্ট এবং সকলের মধ্যে ঈশ্বরের অंश রয়েছে। তিনি বলেন, "অবধে মানুষ, না জাতি, না ধর্ম।" অর্থাৎ, মানুষের মধ্যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নিয়ে কোনো ভেদাভেদ নেই।
সমাজ সংস্কারক:
কবীর ছিলেন এক সমাজ সংস্কারক। তিনি সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস এবং অনৈতিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তাঁর মতে, ধর্মের নামে যে সব কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে তা মানবতার জন্য ক্ষতিকর। তিনি মনে করতেন, প্রকৃত ধর্ম হল মানুষের সেবা করা এবং সত্য পথে চলা।
প্রেম ও ভক্তি:
কবীরের আধ্যাত্মবাদী চিন্তার অন্যতম প্রধান দিক হল প্রেম ও ভক্তি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ঈশ্বরকে পাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হল প্রেম। তাঁর মতে, প্রেমের মাধ্যমে মানুষ ঈশ্বরের নিকটবর্তী হতে পারে। তিনি বলেন, "প্রেম গগন গহিরা, কেহি না পায়ো পার।" অর্থাৎ, প্রেম হল গভীর আকাশের মত, যার কোনো সীমা নেই।
সত্যের সন্ধান:
কবীরের আধ্যাত্মবাদী চিন্তা সত্যের সন্ধানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তাঁর মতে, সত্যই ঈশ্বর। তিনি বলেন, "সত্য বলো, সুপথে চলো, জীবন সুন্দর করো।" তিনি সবসময় সত্য বলার এবং সৎ পথে চলার উপদেশ দিয়েছেন। তাঁর মতে, সত্যের পথে চললে জীবনের সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
বাহ্যিক আড়ম্বরের নিন্দা:
কবীর বাহ্যিক আড়ম্বর এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের তীব্র নিন্দা করেছেন। তাঁর মতে, বাহ্যিক আড়ম্বরের মাধ্যমে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। তিনি মনে করতেন যে ঈশ্বর অন্তরের মধ্যে বিরাজমান এবং অন্তরের পবিত্রতা ও সৎকর্মের মাধ্যমেই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো যায়। তিনি বলেন, "মন চলো নিঝাম ঘরে, সব অন্ধবিশ্বাস ছাড়।" অর্থাৎ, মনকে নিজের ঘরে নিয়ে চল, সব অন্ধবিশ্বাস ত্যাগ কর।
সংস্কারবিরোধী:
কবীর ছিলেন সংস্কারবিরোধী। তিনি সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। তাঁর মতে, ধর্মের নামে যে সব কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে তা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। তিনি মনে করতেন, প্রকৃত ধর্ম হল মানুষের সেবা করা এবং সত্য পথে চলা।
উপসংহার:
কবীরের আধ্যাত্মবাদী চিন্তা আমাদের জীবনের প্রতি গভীর প্রভাব ফেলে। তাঁর চিন্তাধারা আজও মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। তাঁর একেশ্বরবাদ, মানবতাবাদ, ধ্যান, যোগ এবং সত্যের সন্ধানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এক অনন্য আধ্যাত্মিক দর্শন। তাঁর শিক্ষা ও চিন্তাধারা আমাদের জীবনে সত্য, প্রেম এবং মানবতার পথে চলার প্রেরণা যোগায়।
Kalyani University BA 3rd Semester Political Science Major Long Question Answer (SAQ Suggestion) PDF টি পেতে.. আপনি ১১ টাকা পেমেন্ট করুন। পেমেন্টের পর এক সেকেন্ডের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সাজেশনটি পাবেন। টাকা টি পেমেন্ট করার জন্য নিচে PAY বাটনে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।